‘দালান পায়া হামরা খুব খুশি’

সমাজের অবহেলিত হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত হরিজন পল্লি গড়ে তুলেছে উপজেলা প্রশাসন। 

হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য গড়ে তোলা হরিজনপল্লি। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ফকিরপাড়া গ্রামে গতকাল বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

শান্ত বাসফোর (২৫) হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। কাজ করেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার উলিপুর পৌরসভায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। স্ত্রী জুলি বাসফোর ও দুই বছরের সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ বলে কেউ তাঁদের বাসা ভাড়া দেননি। বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চিলমারী উপজেলা শহরের পাশে রেলস্টেশনে ছাপরা তুলে বসবাস করতেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় হরিজন পল্লি আবাসনে ঘর ও জমির দলিল পেয়েছেন শান্ত-জুলি দম্পতি।

জুলি বাসফোর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুইপার হয়ে জন্ম নিয়েছি জন্য কি হামরা মানুষ না? ছোট সন্তান নিয়ে কী অসহ্য যন্ত্রণায় ছাপরায় রাত কাটত, বলে বোঝানো যাবে না। এই সমাজ আমাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করলেও প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এখন সারা দিনের পরিশ্রম শেষে শান্তিতে ঘুমাতে পারব। হামরাও এই দ্যাশের মানুষ, ঘর ও জমির দলিল তার প্রমাণ।’

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো সমাজের অবহেলিত হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত হরিজন পল্লি গড়ে তুলেছে চিলমারী উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামে হরিজন সম্প্রদায়ের ৩০টি পরিবারের জন্য এ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১ লাখ সাড়ে ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিটি ঘরে বারান্দাসহ দুটি কক্ষ, রান্নাঘর, শৌচাগার, পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চিলমারী উপজেলা শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে থানাহাট ইউনিয়নে ফকিরপাড়া গ্রাম। সবুজ ধানখেত ও পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে লাল-হলুদ রঙের দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি আধা পাকা ঘর।

ষাটোর্ধ্ব নীলা রানী বাসফোরের স্বামী রঙ্গলাল বাসফোর চিলমারী উপজেলা পরিষদে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। ওই সময় স্বজনদের নিয়ে উপজেলা পরিষদের একটি পরিত্যক্ত ভবনে থাকতেন। কিন্তু চার বছর আগে রঙ্গলাল বাসফোর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি চাকরি হারান। এরপর নীলা রানীকে সেই পরিত্যক্ত ভবন ছাড়তে হয়। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে নীলা রানী উপজেলা পরিষদের রাস্তার পাশে আশ্রয় নেন।

নীলা রানী বলেন, ‘সারা জীবন ছৈলপৈল নিয়ে বাজারে, রাস্তার ধারে ছিলাম। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে ছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলে টিনের চালার ফুটো দিয়ে পানিতে বিছানা ভিজে যেত। শেষ বয়সে এসে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকাঘর পামো ভাবি নাই। পাকা দালান পায়া হামরা খুব খুশি।’

হরিজন পল্লিতে সারিবদ্ধভাবে ঘরগুলো তৈরি করায় শিশুদের খেলাধুলার বেশ বড় জায়গা তৈরি হয়েছে। সেখানে কয়েকটি শিশুকে খেলতে দেখা গেল। একটি শিশুর নাম পপি (১০)। বছরখানেক আগেও পপি থানাহাট ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। জন্মনিবন্ধন না হওয়ায় তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পপির মতো হরিজন পল্লিতে ২০টি শিশু আছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা মিনি বালা। তিনি বলেন, ‘আমরা চোখ থাকতে অন্ধ হইছি। সরকার আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছে। এখন শিশুদের জন্য একটা স্কুল করে দিলে আমরা খুব খুশি হব। আমাদের মতো সন্তানদের জীবন যেন অন্ধকার না হয়, সরকারের কাছে আমাদের এই দাবি।’

গত ৯ আগস্ট আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপের ৫০৫টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ঘর বিতরণ কর্মসূচি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রুকুনুজ্জামান বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি, তাঁদের যেন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কুড়িগ্রামে এলে তিনি হরিজন সম্প্রদায়ের দাবি তুলে ধরেন। পরে তিনি হরিজন সম্প্রদায়ের দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণে ১ একর জমিতে ৩০টি হরিজন পরিবারকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। হরিজন পল্লিতে নাগরিক সুবিধার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুদের পড়াশোনা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।