ময়মনসিংহে চামড়ার হাটে তোড়জোড়, লবণ মজুত করছেন ব্যবসায়ীরা
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট শহরতলির শম্ভুগঞ্জে। কোরবানির পর এ হাটে বিভাগের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলা ছাড়াও সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার কিছু এলাকা থেকেও চামড়া নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। এ হাট থেকে ঢাকার ট্যানারিমালিকেরা চামড়া কিনে নিয়ে যান।
সারা বছর এ হাট চললেও কোরবানির ঈদ ঘিরে সর্বোচ্চ বেচাকেনা হয় এ হাটে। এ বছর কোরবানির ঈদ ঘিরে এখন থেকেই শুরু হয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি। লবণ কিনে মজুত করছেন তাঁরা। গত বছর কম বিক্রি ও সিন্ডিকেটের কারণে কম দাম পেলেও এবার বেচাকেনা বেশি হবে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শম্ভুগঞ্জের চামড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি। টিনশেডের একটি ঘরে স্তূপ করা লবণের বস্তা ঢেকে রাখছেন ব্যবসায়ী শহীদ মিয়া। ২০০ বস্তা লবণ মজুত করেছেন তিনি। আট বছর ধরে চামড়া ব্যবসা করেন তিনি। এ হাটে শহীদ ছাড়াও ১৫-২০ জন স্থায়ী চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। ঈদ ঘিরে এ হাটে শতাধিক ফড়িয়া ব্যবসায়ীও চামড়া কেনেন। গ্রাম-শহর থেকে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে এ হাটে এনে বিক্রি করেন। সারা বছর সপ্তাহের শনিবার এক দিন করে এ চামড়ার হাট বসছে এখন। তবে কোরবানির ঈদে ঢাকার ট্যানারিমালিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে শনি ও মঙ্গলবার হাট আয়োজন করা হয়েছে।
শহীদ মিয়া ২০০ বস্তা লবণ (প্রতি বস্তায় ৭০ কেজি) ১ হাজার ১০০ টাকা করে কিনেছেন জানিয়ে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে ৫০ টাকা দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি। গত বছর ১ হাজার ৭৭৫ চামড়া কিনলেও এবার ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, একটি গরুর চামড়া পরিষ্কার করে লবণ লাগাতে ৩০০ টাকা খরচ হয়। গত বছর ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা চামড়া বিক্রি হলেও এবার দাম কিছুটা বেশি হবে আশা করছি।’
এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।
অন্তত ৪৫ বছর ধরে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মজিন্দ্র মনি ঋষি বাজার পরিস্থিতি নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ। গত বছর ৯৫০ চামড়া কিনে ৬০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল তাঁর। তিনি বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামে ট্যানারিমালিকেরা চামড়া কিনলে আমরা লাভের মুখ দেখতাম। কিন্তু ট্যানারিমালিকেরা সিন্ডিকেট করে আমাদের ঠকান। তারপরও এবার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ চামড়া কেনার জন্য ১০০ বস্তা লবণ মজুত করেছি।’ মজিন্দ্র বলেন, ‘এবার দাম না পেলে আর হয়তো ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় থাকার কারণে লস হলেও ব্যবসা ছাড়তেও পারছি না।’
পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে ৩ জুন কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।
বাজারে একটি গরুর চামড়া পরিষ্কার করতে দেখা যায় সঞ্জীব মনি ঋষিকে। শম্ভুগঞ্জ বাজারে অন্তত ৩৫ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন তিনি। তিনি বলেন, দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার গরুর চামড়া ৪০০-৬০০ টাকা, এক লাখ টাকার গরুর চামড়া ২০০-৪০০ টাকায় কেনা হবে। গাভির চামড়া ১০০-১৫০ টাকা। লবণ ও মজুরি মিলিয়ে চামড়া প্রতি ৩০০ টাকা খরচ যোগ করে সেটি বিক্রি করতে গিয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা লাভ হয়। ট্যানারি সিন্ডিকেট করলে লোকসানও গুনতে হয়।
৩০ বছর ধরে চামড়া ব্যবসা করেন রাজকুমার ঋষি। গত বছর দুই হাজার চামড়া কিনলেও এবার হাজারখানেক চামড়া কেনার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। রাজকুমার ঋষি বলেন, ট্যানারির লোকজন এসে বলেছে, চামড়ার দাম কম থাকবে, তাই কম দামে কিনতে বলেছে। ট্যানারি দাম সঠিক দিলে কিছু লাভ হবে।
এবার দেড় লাখের বেশি চামড়া শম্ভুগঞ্জ হাট থেকে ট্যানারিমালিকেরা সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন চামড়াবাজারের ইজারাদার আসাদুজ্জামান সোহেল। এবার হাটে ১৫-২০টি ট্যানারিকে আহ্বান জানানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছর চামড়ার দাম কম থাকায় ও আবহাওয়া খারাপ থাকায় এক লাখের কিছু বেশি চামড়া কেনাবেচা হয়। তার আগের বছর ২০২২ সালে প্রায় দেড় লাখ চামড়া বিক্রি হয়েছিল।
ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় জানিয়ে আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যেন ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য ট্যানারিমালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে। গত বছর জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাজার পরিস্থিতি ভালো ছিল না। তবে এবার বাজার ভালো হবে আশা করছি।’
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, দেশের চামড়াশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। চামড়া যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য বাজারে পর্যাপ্ত লবণ মজুত রয়েছে। কোনো সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে।