শিবগঞ্জে ৪০০ বছরের পুরোনো মেলায় মিষ্টির পসরা, আশপাশের গ্রামে উৎসব
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার গাংনগর শিবমন্দিরকে ঘিরে বসেছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলা। একসময় এই মেলার মূল আকর্ষণ ছিল হরেক রকমের মসলা, হলুদ, রসুন, পেঁয়াজ আর শুকনা মরিচের পাইকারি বেচাবিক্রি। গ্রামের কৃষকেরা মেলায় খেতের মসলা বিক্রি করতেন। এর পর তাঁরা মাটির হাঁড়িতে রসগোল্লা কিনে বাড়িতে ফিরতেন। মেলায় প্রসিদ্ধ ছিল কাঠের আসবাবও। বিনোদনের জন্য থাকত যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ আর চলচ্চিত্র তারকাদের অংশগ্রহণে বিচিত্রানুষ্ঠান। তবে কয়েক বছর ধরে করোনা মহামারির বিরতিতে মেলা খানিকটা জৌলুশ হারিয়েছে।
আগে এক মাসব্যাপী মেলা চললেও কয়েক বছর ধরে এক সপ্তাহেই শেষ হচ্ছে মেলার আমেজ। এবার প্রচণ্ড গরমের কারণে মেলার ব্যাপ্তি কমে তিন দিনে ঠেকেছে। গতকাল সোমবার মেলার প্রথম দিনে লোকসমাগম কিছুটা কম হয়েছে।
মেলার আয়োজকেরা জানান, প্রায় ৪০০ বছর ধরে বৈশাখ মাসের প্রথম সোম বা বৃহস্পতিবার যে দিনটি আগে আসে, সেই দিনেই বসে গাংনগরের মেলা। এবার বৈশাখ মাসের প্রথম সোমবার থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা। মেলা উপলক্ষে আশপাশের প্রায় অর্ধশত গ্রামে ঘরে ঘরে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে স্বামী-সন্তানসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মেয়েরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনেরাও নিমন্ত্রণ খেতে এসেছেন।
গতকাল সকালে মেলা ঘুরে দেখা যায়, গাংনগর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বসেছে গাংনগর মেলার মূল অংশ। তবে মেলার পরিধি ছড়িয়ে পড়েছে গাংনগর শিবমন্দির পর্যন্ত। মেলার জৌলুশ কমলেও এখনো সেখানে আগের মতোই বাহারি রসগোল্লা আর নানা পদের মিষ্টির পসরা দেখা গেল। মাটির হাঁড়িতে রসগোল্লা কিনে মেলা থেকে ফিরছেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। আছে নিমকি, খাজা, মাছ, কদমা, ছাঁচ (হাতি-ঘোড়া), খাগড়াই, বাতাসা, জিলাপিসহ হরেক মিঠাই পণ্য। রসগোল্লা মানভেদে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, কদমা, হাতি-ঘোড়ার ছাঁচ ও বাতাসা ১৮০, নিমকি ১৮০, মুড়কি ১৬০, খাগড়াই ১৮০ ও জিলাপি ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মেলায় শিশুদের জন্য বসেছে হরেক খেলনার দোকান।
মিষ্টির দোকানি মাজেদুল ইসলাম বলেন, এবার রোজার মাসে মেলা বসলেও মিষ্টির বেচাবিক্রি ভালো। মাটির হাঁড়িতে রসগোল্লা বিক্রি এই মেলার ঐতিহ্য। প্রতি কেজি রসগোল্লা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বালিশ, মাছ ও লাভ মিষ্টি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা দরে।
স্থানীয় বাসিন্দা ভক্ত সুখা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৪০০ বছর আগে এখানে ‘শিবসাগর’ নামে ১৮ বিঘা আয়তনের একটা পুকুর খনন করা হয়। কথিত আছে, শিবের জল খাওয়ার জন্য একজন হিন্দু জমিদার এই পুকুর খননের পর শিবপূজার মাধ্যমে মেলার গোড়া পত্তন করেন।
গাংনগর শিব ও শীতলা মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক শংকর মোহন্ত বলেন, আগে মেলা উপলক্ষে চড়ক পূজা হতো। এখন শুধু শীতলা মন্দিরে পূজা হয় এবং মন্দির থেকে আনুমানিক ৪০০ গজ দূরে বিদ্যালয় মাঠে বসে মেলা। উপজেলা প্রশাসন থেকে মেলার ডাক হয়।
মেলায় এবারও হরেক মসলার পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। জিরা, লবঙ্গ, এলাচির মতো মসলা ছাড়াও কৃষকের খেতে উৎপাদিত পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, আদা, রসুন, হলুদসহ হরেক মসলার আমদানি হয়েছে। তবে দাম অন্য বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি।
দোকানিরা বলছেন, এবার মেলায় বেচাকেনা ভালো হলেও প্রশাসন থেকে মেলা ইজারা নিয়ে টোল আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছামতো। দোকানের ধরন অনুযায়ী টোল আদায়ের কথা থাকলেও প্রতি হাত জায়গা ২০০ টাকা হিসাবে টোল আদায় করছেন ইজারাদারের লোকজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবারের তিন দিনব্যাপী এই মেলা ৮৫ হাজার টাকা ইজারামূল্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে ডেকে নিয়েছেন শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মেলায় আসা দোকানিদের ‘চিরকুট’ ধরিয়ে দিয়ে প্রতি একহাত জায়গার দাম ২০০ টাকা হারে টোল আদায় করছেন।
তবে শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মেলা বসানো নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিরোধের কারণে আমার নামে ইজারা ডেকে নিয়ে দেউলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম এবং সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোত্তালিবকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা দোকানিদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টোল আদায় করছেন, তা আমার জানা নেই।’
জানতে চাইলে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে কুলসুম প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ দিনব্যাপী গাংনগর মেলা আয়োজনের জন্য ভ্যাট, আয়করসহ ৮৪ হাজার ৮৭৫ টাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। হাটবাজার ইজারার ক্ষেত্রে টোল আদায়ের হার বেঁধে দেওয়া হলেও মেলার ক্ষেত্রে টোলের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয় না। তবে আদায় করা টোল যাতে ব্যবসায়ীদের জন্য জুলুম না হয়, সে জন্য ইজারাদারদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে। গাংনগর মেলায় ইচ্ছামতো টোল আদায় করা হচ্ছে, এমনটা জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।