‘বাড়িতে নিলে আরও নচ হবে’, হাটেই কম দামে চামড়া বিক্রি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর

গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর চামড়ার হাটে বিক্রির সাজিয়ে করে রাখা চামড়া। আজ বুধবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

রংপুর থেকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী চামড়ার হাটে গরুর চামড়া বিক্রি করতে এসেছিলেন সাদিকুল ইসলাম (৪০)। আজ বুধবার সকাল সাতটার দিকে হাটে পৌঁছান তিনি। এরপর ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। কিন্তু কেউ তাঁর চামড়ার দাম বলেননি। কেউ কেউ বললেও তা ছিল পানির দামে। বেলা একটার দিকে বাধ্য হয়ে তিনি ২০ হাজার টাকায় কেনা চামড়া মাত্র ৯ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। ফেরার সময় তিনি বলেন, ‘এগুলে বাড়িত নিয়া গ্যালে আরও বেশি নচ হবি, ম্যালা ট্যাকা ভ্যান ভরা নাগবে। তাই ১১ হাজার ট্যাকা নচ করি বেচনো।’

একই হাটে ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে এসেছিলেন ফুলছড়ির বালাসি গ্রামের সুখলাল রবিদাস (৫৮)। তিনি প্রতিটি ছাগলের চামড়া ২৫০ টাকা দরে মোট সাত হাজার টাকায় কিনেছিলেন। তিনি বলেন, ‘সোকালে হাটোত আচ্চি। পাঁচ হাজার ট্যাকা নচ দিয়া দুই হাজারোত চামড়া বেচনো।’

হাটের এক ক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছাগলের চামড়া ট্যানারির মালিকেরা কিনেন না। তাই পুকুরে মাছের খাবার জন্য প্রতি কেজি ছাগলের চামড়া ৩০ টাকা হিসাবে কিনলাম।’

সাদিকুল ও সুখলালের মতো অন্তত ২৫ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজ একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।

৪০ বছর ধরে ঈদুল আজহার পরের বুধবার এই হাট বসছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কালীবাড়ী এলাকায় গড়ে ওঠা এই হাট উত্তরবঙ্গের অন্যতম পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী চামড়ার হাট। গাইবান্ধাসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া বিক্রি করতে আসেন। এবারের হাটে আসার কথা ছিল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি।

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, হাটে প্রচুর পরিমাণে চামড়া এসেছে। অভ্যন্তরীণ সড়কের পাশে ও শেডের মেঝেতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে সেগুলো। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিক্রির আশায় অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ক্রেতা ছিল হাতে গোনা। দু-চারজন চামড়া কিনেছেন নামমাত্র দামে। অনেকেই চামড়া বিক্রি না করে বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেছেন। কেউ কেউ হাটেই ফেলে দিয়েছেন।

সাদুল্লাপুর উপজেলার খোদ্দকোমরপুর গ্রামের সাহা মণ্ডল (৬০) বলেন, ‘দাদন ব্যবসায়ীর কাছে চড়া সুদে টাকা নিয়ে গরুর চামড়া কিনেছি। আজ দুই হাজার টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করলাম।’

সরকার নির্ধারিত দরে চামড়ার দাম না পেয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। আজ বুধবার দুপুরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর চামড়ার হাটে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের হারাগাছ এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান (৫৫) তিন লাখ টাকার চামড়া বিক্রি করতে এনেছিলেন হাটে। বিক্রি না হওয়ায় তিনি ফেরত নিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘১৮ জুন হাটে আবার নিয়ে আসব।’

গাইবান্ধা শহরের চামড়া ব্যবসায়ী আরশাদ আলী বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনে মজুত করেছিলেন। তাদের ভরসা ছিল, বুধবারের পলাশবাড়ীর হাট। কিন্তু হাটে ট্যানারির মালিকেরা ঢাকা থেকে এসেছিলেন। তাঁরা চামড়া কেনেননি।

পলাশবাড়ী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ট্যানারির মালিকদের চাহিদার ওপর চামড়ার বাজার অনেকটা নির্ভর করছে। তাঁরা আজ খুব একটা চামড়া কেনেননি। রোববার থেকে কিনবেন বলে জানিয়েছেন।

চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০-৫৫ টাকা ও ছাগলের চামড়া ১৭-২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ট্যানারির মালিকেরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন না।

বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানিকারক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত ‘চায়নিজ ট্যানারির’ মালিক শাহিদুল ইসলাম আজ হাটে এলেও কোনো চামড়া কেনেননি। তিনি বলেন, ‘ট্যানারির মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় না করে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। ট্যানারিমালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হতো। প্রাথমিকভাবে কাঁচা চামড়ায় তিনটি গ্রেড হয়। প্রথম গ্রেডের চামড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের চামড়া কোনো দামেই যাচ্ছে না। এগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া লাগছে। বর্তমানে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজের ফলে ৪০ শতাংশ চামড়া আউট অব এক্সপোর্ট হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এ চামড়াগুলো কোনো দামেই বিক্রি হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাকসিন না দেওয়ার কারণে এ বছর ঈদের আগে লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু বেচাকেনা হয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী না বুঝেই এই রোগে আক্রান্ত গরুর চামড়া কিনেছেন।’

চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়ে শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় বিশ্বের ৮০টি দেশে চামড়া রপ্তানি করা হতো। কিন্তু ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকার কারণে আমরা শুধু চীনকেন্দ্রিক একটি মার্কেটে ঝুঁকে পড়েছি। ইউরোপ-আমেরিকায় আমাদের রপ্তানি নেই। চীনের মার্কেটের অবস্থা ভালো না। কেননা, আমেরিকা চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এ কারণে চীন আমাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে আমাদের দেশের চামড়ার বৈদেশিকভাবে কোনো চাহিদা নেই। এই চাহিদা না থাকার কারণে আমাদের চামড়ার বাজারমূল্য অনেক কমে গেছে। কেমিক্যাল মূল্য ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বিক্রি ঢাকার হাজারীবাগ থাকাকালে যে অবস্থায় ছিল, এখন সেই অবস্থায় নেই। আন্তর্জাতিক পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী ও আন্তর্জাতিক এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে আমরা বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির কাছে চামড়া বিক্রি করতে পারি না। আমরা শুধু নামমাত্র মূল্যে চীনের কাছে চামড়া বিক্রি করি। যার কারণে আমাদের চামড়ার বাজারের করুণ অবস্থা।’