নালার কাদায় ঢাকা ‘ক্লিন সিটি’ রাজশাহী নগরের রাস্তা

ড্রেন পরিষ্কারের পর কাদা তুলে রাস্তার ওপর শুকানো হয়। এতে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, এই কাদা শুকিয়ে বাতাসে মিশছে।

নালা থেকে কাদা তুলে এভাবেই রাস্তার ওপর শুকাতে দেওয়া হয়। সম্প্রতি রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

‘ক্লিন সিটি’ হিসেবে রাজশাহী মহানগরের খ্যাতি এখন দেশজুড়ে। রাতের বেলায় একদল কর্মী রাস্তায় নামেন। সকাল হওয়ার আগেই তাঁরা নগরের রাস্তাঘাট ঝকঝকে করে ফেলেন। নির্মল বায়ুর শহর হিসেবে এই শহর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। কিন্তু এখনো ১০০ কিলোমিটারের বেশি নর্দমার (ড্রেন) কাদা তুলে রাস্তার পাশে রেখে, রোদে শুকিয়ে তারপর ভাগাড়ে ফেলতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য সরানো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পৃথিবীর অন্যান্য শহরে ড্রেনের বর্জ্য সরাসরি গাড়িতে তুলে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলা হয়। সিটি করপোরেশন বলছে, নগরে ১০০ কিলোমিটারের বেশি ছোট ছোট ড্রেন রয়েছে। এই ড্রেনের কাদা এভাবেই তুলতে হবে। আপাতত কোনো বিকল্প নেই।

সম্প্রতি রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকার ড্রেন পরিষ্কার করা হলো। এ জন্য কাদা তুলে রাস্তার ওপর শুকানোর জন্য রেখে দেওয়া হলো। এতে মানুষের চলাচল যেমন বিঘ্নিত হলো, তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই কাদা শুকিয়ে বাতাসে মিশছে। নিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, উড়ে বাড়িঘরে যাচ্ছে; খাবারদাবারে পড়ছে। 

কাজীহাটা এলাকার একটি রেস্তোরাঁ একেবারে রাস্তা লাগোয়া। এই দোকানের একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় পাঁচ দিন ধরে ড্রেনের কাদা তাঁদের রেস্তোরাঁর সামনে রাখা ছিল। একেবারে মাটি হওয়ার পরে সেই কাদা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। ওই কর্মচারী স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা জানেন না। তাঁদের চলাচলের অসুবিধা ও মুখের সামনে ড্রেনের কাদা রেখে রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশনের বিষয়টি ভালো লাগে না বলে জানালেন তিনি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, ছোট ড্রেনগুলোতে এক্সকাভেটর ব্যবহার করা যায় না। এগুলো আপাতত এইভাবেই করতে হবে। তিনি বলেন, ‘তারপরও আমরা সচেষ্ট থাকি। ধুলার পর্যায়ে যেতে দিই না। ট্রাকে তোলার মতো একটু শক্ত হলেই আমরা অপসারণ করে থাকি।’

২০১৬ সালের ১৭ জুন দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণ কমানোয় রাজশাহীকে বিশ্বের সেরা ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে পরের দিন ১৮ জুন ‘বায়ুদূষণ কমানোয় রাজশাহী বিশ্বসেরা’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাতাসে ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের যে ক্ষতিকর কণা ভেসে বেড়ায়, তা ২০১৪ সালে রাজশাহীর বাতাসে প্রতি বর্গমাইলে ছিল ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম। পরের দুই বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ৯। প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ক্ষতিকর কণা হ্রাসের হার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রাজশাহীর সমন্বয়কারী তন্ময় স্যান্নাল প্রথম আলোকে বলেন, নির্মল বাতাসের জন্য রাজশাহী বিশ্বের সেরা শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই শহরের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নির্বিঘ্নে চলাচল ও সৌন্দর্য সুরক্ষার জন্য ড্রেনের বর্জ্য অপসারণ সরাসরি কাভার্ড ট্রাকের মাধ্যমে করা উচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এম মঞ্জুর হোসেন বলেন, ড্রেনের পানিতে হাসপাতাল, ক্লিনিকের বর্জ্য ফেলা হয়, যা পুড়িয়ে ফেলার কথা। সেই সঙ্গে মানুষ্য বর্জ্যও গিয়ে মিশছে। এতে কোলিফরম, সালমোনেলা, ইকোলি ও সিগেলা–জাতীয় ভয়ংকর সব ব্যাকটেরিয়া থাকে, যার ভেতরে মানবদেহের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর সব রোগজীবাণু থাকে। যা ডায়রিয়া, আমাশয়, ক্রিমিসহ পেটের পীড়ার জীবাণু বহন করে। তিনি বলেন, ট্রাকে পলিথিন ব্যবহার করে সঙ্গে সঙ্গেই ভাগাড়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফয়সল আলম বলেন, বর্জ্য সরাসরি অপসারণ করা উচিত। এতে রাস্তায় চলাচল করতে গিয়েও বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। আবার শুকিয়ে ধুলা হয়ে বাতাসে মিশছে। যা শ্বাসকষ্টের বা অ্যাজমা রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।