নৌকায় পারাপার, ভোগান্তি

একটিমাত্র নৌকা বাসিন্দাদের পারাপার করছে। ভিড় হয়ে যাওয়ায় কাউকে কাউকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভা নয় মহল্লার বাসিন্দাদের উপজেলা সদরে যেতে নৌকায় কুমার নদ পার হতে হয়। গতকাল বেলা একটার দিকেছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার আটটি মহল্লার বাসিন্দাদের উপজেলা সদরে যেতে নৌকায় করে কুমার নদ পার হতে হয়। নদীপথে না গেলে উপজেলা সদরে যেতে হলে তাদের দুই কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। এ অবস্থায় আড়াই হাজার মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এলাকাবাসীর আক্ষেপ, পৌরসভার বাসিন্দা হওয়ার পরও তাঁদের নৌকায় করে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌর এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। এ নদের উত্তরে নগরকান্দা পৌরসভার চৌমুখা, দক্ষিণে গাঙ্গজগদিয়া মহল্লা অবস্থিত। কুমার নদটি ফরিদপুর সদরের মদনখালী এলাকায় পদ্মা নদী থেকে শুরু হয়ে ফরিদপুরের সালথা, নগরকান্দা, ভাঙ্গা হয়ে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার সেনদিয়া ঘাট এলাকায় বিল রুট ক্যানেলে গিয়ে মিশেছে।

গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, গাঙ্গজগদিয়া এলাকার নদের পাড়ে লোকজন অপেক্ষা করছে নদটি পার হওয়ার জন্য। একটিমাত্র নৌকা চলাচল করছে। এর ফলে নদ পার হতে কাউকে কাউকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। চলাচলকারীদের মধ্যে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী ও বাজারের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন।

পাঁচ বছর ধরে খেয়ানৌকায় মানুষ পারাপার করছেন চৌমুখা গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ কুমার দাস (৫৬)। তিনি বলেন, খেয়ানৌকায় প্রতিবার ১০–১২ জন করে প্রতিদিন হাজারখানেক লোক পার করা হয়। তাদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজর শিক্ষার্থী। রাতে ও দুপুরের খাবারের সময়সহ অনেক সময় তিনি ঘাটে থাকতে পারেন না। তখন ভিড় লেগে যায়।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১০ সালে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌমুখা ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গাঙ্গজগদিয়া এলাকায় কুমার নদের ওপর প্রায় ৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২ মিটার প্রস্থের একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়। সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে সাঁকোটি তৈরি করে নগরকান্দা পৌরসভা। পৌরসভার জুংগুরদী, শশা, সলিথা, গাঙ্গজগদিয়া, নগরকান্দা, কলেজ বালিয়া, মিনার গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম ও মহল্লার অন্তত আড়াই হাজার মানুষ এই সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করত। ওই সাঁকো দিয়ে হাঁটার পাশাপাশি সাইকেল নিয়েও যাতায়াত করা যেত।

কিন্তু সংস্কার ও মেরামতের অভাবে ২০১৯ সালে সাঁকোটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। এর পর থেকেই নদের দুই পাড়ের মানুষ যাতায়াতের জন্য নৌকার ওপর নির্ভরশীল। এ পথে একটি নৌকাই চলাচল করে। কারও সঙ্গে মালামাল থাকলে তাঁকে দুই কিলোমিটার দূরে তালমা-জয়বাংলা আঞ্চলিক সড়কের জুংগুরদী এলাকার বেইলি সেতু দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এর ফলে ওই এলাকার মানুষকে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার পথ বেশি ঘুরতে হচ্ছে। প্রতিবার খেয়া পার হওয়ার জন্য জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে দিতে হয়।

নগরকান্দা সরকারি মহেন্দ্র নারায়ণ একাডেমি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আকরামুন্নেসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, নগরকান্দা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আইডিয়াল হাইস্কুল, ইসলামি আদর্শ শিশুশিক্ষালয়, নগরকান্দা সরকারি মহাবিদ্যালয়, থানা, উপজেলা পরিষদ, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, নগরকান্দা বাজারসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদের দক্ষিণে অবস্থিত। এর ফলে উত্তর দিকের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে নদী পার হতে হয়।

জুংগুরদী মহল্লার বাসিন্দা সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া খান (২৪) বলেন, ‘অনেক সময় আমাদের অনেক জরুরি প্রয়োজন থাকে, তখন ঘাটে নৌকা থাকলেও মাঝি থাকেন না। এর ফলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। এর থেকে কবে মুক্তি পাব, আমরা জানি না। পৌরসভার মেয়রের কাছে আমরা একটা সেতু নির্মাণের দাবি জানাই।’

স্থানীয় বাসিন্দারা আরও বলেন, চৌমুখা ও জুংগুরদী গ্রামে বসবাসরত বাসিন্দাদের অধিকাংশ লোকই ব্যবসায়ী। তাঁদের নগরকান্দা বাজারে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ জন্য প্রতিদিন সকালে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় ও বাড়িতে ফেরার সময় খেয়াঘাটে ভিড় লেগে যায়।

নগরকান্দা বাজারের সোনা ব্যবসায়ী গোপাল দত্ত (২৮) বলেন, ‘যখন এখানে আমাদের পারাপারের জন্য সাঁকো ছিল, তখন আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এবার এখানে সেতু হবে। সাঁকো ভেঙে গেছে প্রায় পাঁচ বছর হলো। এরপর সাঁকো তো হলোই না, বরং তখন থেকে খেয়ানৌকায় চলাচল করছি। সেতু আদৌ হবে কি না, তা–ও অজানা।’

নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নিমাই চন্দ্র সরকার বলেন, সেতু না থাকায় নয়টি মহল্লার মানুষদের পারাপারের জন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এই নদ দিয়ে ট্রলার চলে। এর ফলে বাঁশের সাঁকো করা এখানে কঠিন। এ জন্য এখানে একটি আরসিসি সেতু নির্মাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নগরকান্দা উপজেলা প্রকৌশলী মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, জায়গাটি পৌরসভার আওতাধীন। এ জন্য সেখানে সেতু করা সম্ভব কি না, এর সম্ভাব্যতা পৌর কর্তৃপক্ষকেই নিরূপণ করতে হবে। পৌরসভার সীমানার মধ্যে তাঁদের কাজ করার সুযোগ কম। সাময়িক চলাচলের জন্য ওখানে বাঁশের সাঁকো করার কথা তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন।

চৌমুখা মহল্লার বাসিন্দা সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শাওন সরকার (২৬) বলেন, ‘দেশে এত বড় বড় উন্নয়ন হচ্ছে। অথচ আমাদের নগরকান্দা বাজারে যেতে হলে সেতু বা সাঁকো না থাকার কারণে নৌকায় পারাপার হতে হয়। পৌরসভার একজন বাসিন্দা হয়ে এখনো নৌকায় পার হওয়ার বিষয়টি ভাবতেও পারি না।’