বদলে যাওয়া হাওরে মাছের আকাল

হাওরে পানি নেই। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতেছবি: প্রথম আলো

হাওর-সংস্কৃতিতে হাওরপারের মানুষের কাছে মাছ জীবিকার একটি বড় উপায়। বংশ পরম্পরায় অনেকেরই পেশা মাছ শিকার। শখে মাছ ধরে প্রতিদিনের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন অনেকে। কিন্তু মৌলভীবাজারের সেই হাওরে আর আগের মতো মাছের প্রাচুর্য নেই।

হাওরের প্রকৃতিতে বদল এসেছে। সময় মতো হাওরে পানি আসে না। বিলঝিল শুকিয়ে মাছ ধরা এবং ক্ষতিকর জালে মাছ শিকারের কারণে হাওরে স্থানীয় জাতের মাছের আকাল চলছে। স্থানীয় হাওর-বাওড়, খাল, নদ-নদীর মাছের দেখা মিলছে না হাটবাজারে। হাওরপারের মানুষের কাছে চার-পাঁচ বছর ধরে এই পরিবর্তনটা বেশি চোখে পড়ছে।

সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুরে করুণা সরকারের (৫০) সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁধে মাছের ডোলা নিয়ে হাওরের দিকে যাচ্ছিলেন। হাওরে ‘দাওইন’ দেবেন। বাঁশ-বেতের তৈরি চাঁই (মাছ ধরার ফাঁদ) ও বড়শি পেতে মাছ ধরা হবে। স্থানীয় লোকজনের কাছে তা ‘দাওইন’ নামে পরিচিত। তিনি বললেন, আগের মতো মাছ মেলে না।  

করুণা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে ১০০–২০০ টাকার মাছ পাই। কয়েক বছর আগেও হাজার-বারো শ টাকার মাছ পাইছি। পুঁটি, চ্যাং (টাকি), মাগুর, শোল অনেক জাতের মাছ। দিন দিন খালি মাছ কমের দিকে যাচ্ছে।’

কাদিপুর সড়কেই দেখা সুভাষ সরকারের (৪৫) সঙ্গে। তাঁর বাড়ি কাদিপুরের পাশের গ্রাম রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতে। তিনি সকালবেলা স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার টাকি মাছ কিনে মৌলভীবাজার শহরে বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন চিংড়ি, টাকিসহ যে ধরনের মাছ পান, তা-ই শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু তাঁর এই বয়সের মধ্যেই কাউয়াদীঘি হাওরসহ স্থানীয় প্রকৃতিকে তিনি বদলে যেতে দেখছেন। পেশার কারণে মাছের সংকট, মাছের আকালটাই এখন তাঁর চোখে বেশি পড়ছে।

হাওরের এই বদলে যাওয়াটা আরও অনেকের মতো বেশ কয়েক বছর ধরে উপলব্ধি করছেন কাদিপুরের সতীন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, ‘এখন বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেও পানি কম অয় (হয়)। বৃষ্টি কম অয়। চাইর-পাঁচ বছর আগেও অন্তেহরি, কাদিপুর থাকি ২০-৩০ জন মাছ লইয়া (নিয়ে) শহরে যাইত। এখন কোনোরকম পাঁচ-সাতজন যাইতো পারে। মাছ পাইলেতো যাইতো।’

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মাছ কম হওয়ার বড় একটা কারণ হচ্ছে শুকনা মৌসুমে হাওরের বিভিন্ন বিল থেকে ইজারাদাররা দুই-তিনবার সেচ দিয়ে মাছ ধরে থাকেন। এতে বিলের কোনো মাছই রক্ষা পায় না। মাছের বংশ বাঁচে না। আগে বিলগুলোতে তিন বছরে একবার মাছ ধরা হতো। এতে ভাসান পানিতে মাছ ডিম ছাড়ত, অনেক মাছ মিলত। শুধু জেলেরাই না, শৌখিন মানুষও অনেক মাছ পেতেন। হাওরপারের মানুষ মাছ শিকার করে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করতে পারতেন। এখন প্রতিবছরই বিল থেকে মাছ ধরা হচ্ছে।

কাদিপুরের বদরুল মিয়া (৩০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের মতো বৃষ্টি অয় না। নিম্নচাপে কিছু বৃষ্টি অইছে। এই বৃষ্টিতে হাওরে পানি অইছে। টানা বৃষ্টি নাই। আমরার ছোটবেলাও দেখছি বৈশাখ মাসে ধান কাটা শুরু অইছে। একদিন বৃষ্টি অইছে, হাওর ভরি গেছে। এখন ১০–১২ দিন পরে একদিন বৃষ্টি অয়। এবারও বৈশাখ মাসে দুই-তিন দিন অল্প বৃষ্টি অইছে, মানুষ অগ্রহায়ণ মাসের মতো ধান তুলছে। সাত-আট বছর আগে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রামের রাস্তা ডুবি যাইতো। যে কেউ মাছ মারিয়া খাইলিছে (মেরে খেতে পারছে), এখন কিনিয়া পার (কিনে পাচ্ছে) না। পানি নাই, মাছ নাই।’

কাউয়াদীঘি হাওর জেলার অন্যতম একটি মিঠাপানির জলাশয়। মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার আটটি ইউনিয়নজুড়ে এই হাওরের বিস্তৃতি। এ ছাড়া জেলায় হাকালুকি, হাইল হাওরসহ ছোট ছোট অনেকগুলো হাওর আছে। যা কম-বেশি সারা বছরই স্থানীয় মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করেছে। কিন্তু বছর কয়েকের মতো এবারও বর্ষা শুরুর মৌসুম থেকে হাটবাজারে স্থানীয় হাওর-বাঁওড়ের মাছ নেই।

মৌলভীবাজার শহরের টিসি মার্কেটের নিয়মিত খুচরা মাছ বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, তিনি মূলত হাওর-নদীর মাছ বিক্রি করে থাকেন। এখন এই মাছ মিলছে না। তাই তিনিও ব্যবসায় অনিয়মিত হয়ে গেছেন।

জয়ন্তী সরকার প্রায় ৩৫ বছর আগে গৃহবধূ হয়ে এসেছিলেন কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুরে। তিনি বলেন, ‘তখন দেখছি অনেক মাছ মিলতো। এখন মাছ অনেক কম। বেকার মানুষ মাছ পায় না। খাইবার মাছই মিলে না।’

মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহনেওয়াজ সিরাজী মঙ্গলবার এ বিষয়ে বলেন, ‘মৌলভীবাজার কাউয়াদীঘি, হাকালুকি ও হাইল হাওর অধ্যুষিত। কিন্তু আগের মতো মাছ নেই। প্রজাতি কমছে, পরিমাণেও কমছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় গত দুই বছর ধরে অনেক কম মাছ। মূল কারণ, জলবায়ুর পরিবর্তন। সময়মতো হাওরে পানি না আসা। ধারাবাহিক মৌসুমের বৃষ্টি হচ্ছে না। শুকনা মৌসুমে মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরা এবং ক্ষতিকর নিষিদ্ধ জাল দিয়ে ডিমসহ পোনা মাছ শিকার করাসহ নানা কারণে স্থানীয় মাছ বিলুপ্তির দিকে। মাছ বংশ বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে না।’