গাইবান্ধায় গোলটেবিল বৈঠক
নারীদের আসন বাড়ানো, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষার দাবি
জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে নারী আসন বাড়িয়ে সরাসরি ভোট, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও নির্বাচনী ব্যয় কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। গাইবান্ধায় আজ সোমবার জেলা পর্যায়ের সংলাপে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এ আহ্বান জানান।
গাইবান্ধা জেলা শহরের সার্কুলার রোডের একটি হোটেলের মিলনায়তনে বেলা ১১টা থেকে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় একশনএইডের নেতৃত্বে সুশীল প্রকল্পের অধীনে গাইবান্ধার বেসরকারি সংগঠন এস কে এস ফাউন্ডেশন এ বৈঠকের আয়োজন করে। এ আয়োজনের প্রচার সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রথম আলো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফিয়াদুর রহমান বলেন, মধ্যপন্থার রাজনৈতিক দল হিসেবে ডানপন্থা ও বামপন্থার মধ্যে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার মাধ্যমে এনসিপি দলিত, উপজাতি ও সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করে যাবে। জাতীয় সংসদে নারীদের আসন বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এনসিপির পক্ষ থেকে মনে করি, নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে।’
তরুণসমাজ, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মাহমুদুন্নবী বলেন, তাঁদের দলের ৩১ দফায় এসব বিষয় স্পষ্টভাবে বলা আছে। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, একই কাজ নারী ও পুরুষ উভয়কে করতে দিলে নারীরাই সেই কাজ ভালো করে। বিএনপি নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী।’
জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মো. আবদুর রহিম সরকার মনে করেন, ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান শুধু নির্বাচনের জন্য আসেনি। যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা নতুন বাংলাদেশের কথা বলেছেন—এটা তাঁদের আকাঙ্ক্ষা। ৫৪ বছরের যে বাংলাদেশ ছিল, তার পরিবর্তন আনতে হবে। জুলাই সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে হবে। সংস্কার অবশ্যই হতে হবে। না হলে আগের মতো ভোট ডাকাতি হবে। পেশিশক্তি ও কালোটাকার শক্তি ভোটকেন্দ্রকে অনিরাপদ করে দিতে পারে। পিআর পদ্ধতির যৌক্তিকতাও তুলে ধরেন আবদুর রহিম। নারীদের আসন বৃদ্ধির পক্ষেও মত দেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকে সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১০০ করার পাশাপাশি এসব আসনে সরাসরি নির্বাচন নিশ্চিত করার দাবি জানার বাসদ (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন। তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার এখনো সেভাবে মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারেনি। গত এক বছরের গাইবান্ধা জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরে নিলুফার বলেন, গত আট মাসেই প্রায় ১৪০টি খুন, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, মব সন্ত্রাস বন্ধে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় গরিব মানুষের অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ নেই বলে মনে করেন জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মুরাদজামান রব্বানী। তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় শতকরা ৯৯ ভাগ গরিব–মেহনতি মানুষের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। শুধু ধনী মানুষের আছে। তাই নির্বাচন কমিশনকে মনোনয়ন দাখিলের টাকা ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে হবে। কমিশনকেই প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় বহন করতে হবে।
জেলা বাসদের আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু হতে হলে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনৈতিক দল, সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার ও সর্বোচ্চসংখ্যক দলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন অপরিহার্য বলে মনে করেন গাইবান্ধা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আফরোজা বেগম।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা শাখার সহসভাপতি জিয়াউল হকের আহ্বান, জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতে হলে ভোটার, ভোটসংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সহজগম্যতা করতে হবে। তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাতে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের ওপর কোনো প্রকার চাপ ও প্রভাব বিস্তার করা না হয়, সে ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গাইবান্ধা সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক শিরিন আক্তার। গাইবান্ধার লেখক ও সাহিত্যিক মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন–পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যে সহিংসতা হয়ে থাকে, ভোটের আগের রাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর যে অত্যাচার–নিপীড়ন হয়ে থাকে, ভোট বিক্রি হয়, তা আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেন না হয়, সে জন্য প্রশাসনকে সজাগ থাকতে হবে।’
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরিফুল হক। তাঁর মতে, প্রতি জেলায় জেলায় রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও ভালো মানুষদের নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত বৈঠক করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে মাঠপর্যায়ে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
বৈঠকের শুরুতে নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলোর দেওয়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশাবিষয়ক সুপারিশমালা পাঠ করেন বেসরকারি সংগঠন জিআরডিএফের নির্বাহী পরিচালক আসাদুল ইসলাম। এর আগে প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একশনএইডের উইমেন রাইটস লিড মরিয়ম নেছা।
শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এস কে এস ফাউন্ডেশনের পাবলিক রিলেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং সমন্বয়কারী আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে গাইবান্ধার সমতল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত ও ঝুঁকিমুক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে।