জঙ্গলে চুনের মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড়

গ্রামের পাশে বন বিভাগের জঙ্গল। সেই জঙ্গলে দল বেঁধে প্রবেশ করছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নারী-পুরুষ, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা। তাঁদের কারও হাতে খাজা ও বাতাসার প্যাকেট। আবার কারও হাতে পলিথিনে মোড়ানো চুনের ছোট-বড় থলে। জঙ্গলের ভেতরে সবাই পাকুড়গাছের নিচে থাকা এক কিশোরের হাতে চুন তুলে দেন।

১৪ বছর বয়সী ওই কিশোর মাটির উঁচু ঢিবির গায়ে দুই হাতে অনবরত চুন লেপে দিচ্ছে। ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু। তাঁদের কেউ কেউ হাতে থাকা চুনের থলে ওই কিশোরের হাতে তুলে দিয়ে ঢিবির দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করছেন। আবার কেউ হাতের ইশারায় প্রণাম করছেন। কৌতূহলী হয়ে এসব দেখছেন কেউ কেউ।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এমন দৃশ্য দেখা গেল দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের দেবীপুর গ্রামসংলগ্ন বন বিভাগের জঙ্গলে। জঙ্গলের উত্তরের সীমানা ঘেঁষে উপজেলার ৩ নম্বর খানপুর ইউনিয়নের পান্নাতপুর গ্রাম। আর দক্ষিণে পৌরসভার দেবীপুর গ্রাম। দুই গ্রামের মধ্যে বন বিভাগের সামাজিক বন।

জঙ্গলের উঁচু ঢিবিতে স্থানীয় বাসিন্দা আনছার আলী দেওয়ান নামের এক ব্যক্তির সমাধি। যা স্থানীয়ভাবে ‘পীরের মাজার’ হিসেবে পরিচিত। এই মাজারকে কেন্দ্র করে চুনের মেলা বসে। ঘটনাচক্রে প্রতিবছর বৈশাখ মাসে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুনের মেলা হয়। অর্ধশতাধিক বছর ধরে এই মেলা বসছে।

ওই সমাধিস্থল থেকে একটু দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা স্থানে গতকাল বিকেলে নিত্যানন্দ সরকার (৬৭), জগদীশ সরকার (৬২) ও সুনীল সরকার (৭০) নামের তিন দোকানি চুনের দোকান নিয়ে বসে ছিলেন। দোকান থেকে শত শত নারী-পুরুষ ১০ টাকা, ২০ টাকা ও ৪০ টাকা দিয়ে পলিথিনের থলে ভরা চুন কিনে নিচ্ছেন। সেই চুন ‘পীরের’ সমাধিস্থলে থাকা কিশোর লুৎফর রহমানের হাত তুলে দিচ্ছেন। লুৎফর রহমান সেই চুন সমাধির গায়ে দুই হাতে লেপন করে দিচ্ছে। সমাধির পাশেই মেলায় দেখা গেল খেলনা, খাজা, বাতাসা, ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, জিলাপি, প্রসাধনসহ শতাধিক দোকান। এখানে আসা লোকজন বিশ্বাস করেন, ‘পীরের মাজারে চুন লেপন করলে মনের আশা পূর্ণ হয়।’

আলাপকালে গতকাল চুনের দোকানি নিত্যানন্দ সরকার বললেন, ‘চুনের এই ম্যালাত মুই ৪০ বছর ধরে চুনের দোকান দ্যাও। আগে তো বাপ ও বড় দাদা এ্যাটে চুনের দোকান দ্যাছোলো। বাপ-দাদা বাঁচে নাই। এখন মুই নিজেই দোকান দ্যাও। আজ বিকালে ১০ ধাড়া (৫০ কেজি) চুন আনিছুনু। এক মণ চুন বিক্রি হইচে।’

দর্শনার্থীদের কেউ কেউ খাজা বা বাতাসা কিনছেন। পরে এসব সমাধির পাশে বসা বৃদ্ধ নারী মেহেরজানের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তিনি সেগুলো দর্শনার্থীদের হাতে মুঠ ভরে বিলি করেন। আনছার আলী দেওয়ানের দূর সম্পর্কের স্বজন হিসেবে পরিচিত মেহেরজান। তিনি প্রতিবছর চুনের মেলায় সমাধির পাশে বসে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের সেবা করেন।

সমাধিতে চুন দিতে এসেছেন বিরামপুর পৌর শহরের রূপনগর মহল্লার বাসিন্দা শাহিনুর রহমান (৪৬)। তিনি বলেন, বিভিন্ন মানতে আট বছর ধরে তিনি এই মেলাতে এসে মাজারে চুন দিচ্ছেন। এবার নিজের জন্য মানত করে চুন দিতে এসেছেন।

মেলার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও আনছার আলী দেওয়ানের বংশের এক স্বজন শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা বসে। আগে মাজারের পাশে মেলা বসত। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাজার থেকে একটু দূরে ফাঁকা মাঠে এখন মেলা বসেছে। এ মেলা বৈশাখ মাসের আরও দুই বৃহস্পতিবার বসবে।

বিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, চুনের মেলার বিষয়ে মেলা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। তবে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে পুলিশ সহযোগিতা করবে।