কিডনি কেনাবেচার অপরাধে কারও বিচার হয়নি

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি ও জয়পুর বহুতি পাশাপাশি ছোট দুটি গ্রাম। গ্রামের বেশ কয়েকজন দরিদ্র মানুষ প্রতারিত হয়ে কিডনি বিক্রি করেছেন
ছবি: সোয়েল রানা

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলায় কিডনি বেচাকেনা বন্ধের উদ্যোগ পুলিশের মামলা দায়ের করার মধ্যেই আটকে আছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা হয়েছে। একটি মামলারও বিচার শেষ হয়নি, কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত

থাকার অভিযোগে কারও শাস্তি হয়নি। কিডনি কেনাবেচা চলছে।

জয়পুরহাট জেলার পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন মামলায় ১২১ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জেলহাজতে আছেন ৪৭ জন।

জয়পুরহাট জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেছেন, ১৫টি মামলার মধ্যে ১৩টির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কোনো মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি।

কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে কেউ কেউ আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ব্যাপারে মাছুম আহাম্মদ ভূইয়া বলেন, ‘আগে কী হয়েছে, জানি না। আমরা এখন কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

আরও পড়ুন

গৎবাঁধা অভিযোগ

কালাই থানা, জয়পুরহাট পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং আদালতে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে প্রতিটি মামলার অপরাধের বর্ণনা আছে। বর্ণনা মোটামুটি এক ধাঁচের, গৎবাঁধা। দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা ও ১৯৯৯ সালের মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের উল্লেখ করে কয়েকটি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলে হয়েছে, ‘প্রতারণার মাধ্যমে প্রতারিত করিয়া মানব দেহের কিডনি বিক্রয়, অঙ্গহানি করত হত্যার চেষ্টার অপরাধ।’ কয়েকটি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলা হয়েছে, ‘প্রতারণার মাধ্যমে প্ররোচিত করিয়া মানব দেহের কিডনি বিক্রয়, অঙ্গহানি করতঃ হত্যার চেষ্টার অপরাধ।’

শুধু ২০১১ সালে প্রথম মামলাটির ক্ষেত্রে বলা আছে: ‘প্রতারণার মাধ্যমে প্রতারিত করিয়া মানব দেহের কিডনি বিক্রয় করার অপরাধ।’

প্রথম মামলা
প্রতারণা করে কিডনি বিক্রির অপরাধে ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কালাই থানায় প্রথম মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়।

পুলিশ বলছে, কিডনি বিক্রির অপরাধ বা ‘হত্যাচেষ্টার অপরাধ’ করার পরও অনেকে জামিন পাচ্ছে। জামিন পেয়ে একই অপরাধ করে চলেছে। পুলিশ ২০১১ সালে বহুতি গ্রামের মো. আ. আবদুস সাত্তারকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিন পান। ২০১৩ সালের অপর একটি মামলায় সাত্তারকে আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়। সাত্তার আবার জামিন পান। পুলিশ বলছে, সাত্তার এখন ভারতে থাকেন। সেখানে বসেই কিডনি কেনাবেচার দালালি করছেন। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।

২০১৫ সালের অন্য একটি মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দেয় ২০১৬ সালে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে: ‘আসামীরা জামিনে মুক্তি পাইয়া এলাকায় আসিয়া একই অপরাধ করিতেছে। ঋণগ্রস্ত দরিদ্র মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে কিডনি ও লিভারের মতো শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ বিক্রয় বা পাচারের মত অপরাধে লিপ্ত হইয়া ঐ এলাকার মানুষের জীবন হুমকির মুখে ঠেলিয়া দিতেছে।’

বিক্রির পেছনে স্বামী

জয়পুরহাট জেলায় কিডনিবিষয়ক ১৫টি মামলার ১৪টির বাদী পুলিশ। একটি মামলার বাদী একজন নারী। তিনি ২০১৬ সালের ৯ জুলাই কালাই

থানায় তাঁর স্বামী, ভাসুর, জাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয় ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ওই নারীর স্বামী এলাকার কিডনি দালালচক্রের অন্যতম সদস্য। মামলার আরেক আসামি চিকিৎসার কথা বলে ২০১৬ সালের মে মাসে তাঁকে প্রথমে ঢাকায় নিয়ে যান। তারপর সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে একটি হাসপাতালে তাঁর একটি কিডনি নেওয়া হয়। কলকাতা থেকে ফিরলে তাঁকে একটি বাড়িতে দেড় মাস আটকে রাখা হয়। সঙ্গে ছিল এক মেয়ে (১০) ও এক ছেলে (১২)। একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন তাঁর ছেলে ও মেয়ের কিডনি বিক্রির চক্রান্তের কথা। তিনি ছেলেমেয়েসহ ওই বাড়ি থেকে পালাতে সক্ষম হন। তারপর স্বামীকে এক নম্বর আসামি করে মামলা করেন।

এ পর্যন্ত যত মামলা
২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৫টি। আসামি ১২১ জন। তাঁদের মধ্যে কারাগারে ৪৭ জন।

ওই নারী এখন কালাইয়ে থাকেন না। তাঁর বোন প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী ওই নারী ঢাকায় থাকেন। নতুন সংসার। ছেলে ও মেয়ে পার্বতীপুর থাকে। ছেলে প্রথম আলোকে বলে, তার মা কিডনি বিক্রি করে কোনো টাকা পাননি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু কথা বলতে পারে না।

প্রথম মামলার সর্বশেষ অবস্থা

প্রতারণা করে কিডনি বিক্রির অপরাধে ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কালাই থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। এর বাদী ছিলেন কালাই থানার এসআই নিপেন্দ্রনাথ ঘোষ। ওই মামলায় প্রথমে ১০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের বাড়ি ছিল কালাই থানার বহুতি, জয়পুর বহুতি, ভেরেন্ডি, উলিপুর, নওয়ানা গ্রামে। এটাই কিডনি বিক্রি বিষয়ে করা প্রথম মামলা।

ওই সময় পুলিশ খুব তৎপর ছিল। গোয়েন্দা পুলিশ কিডনি ব্যবসায়ী চক্রের মূল তারেক আজম ওরফে বাবুল চৌধুরীকে ঢাকা থেকে, আরেক দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদকে বাগেরহাটহাট থেকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক দিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিতে কিডনির মামলাটি ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। মামলা দায়েরের ৪২৮ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর অভিযুক্ত চিকিৎসক, ক্লিনিক-হাসপাতালকে অব্যাহতি দিয়ে মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। কিডনি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে জয়পুরহাটের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন কালাই থানার তৎকালীন ওসি নুর হোসেন।

তবে অভিযোগ আছে, অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগীরা কিডনি ব্যবসার সঙ্গে রাজধানীর নামীদামি কয়েকটি হাসপাতাল–ক্লিনিককে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও অভিযোগপত্র থেকে সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এখনো এই মামলার বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়ে কালাই থানার ওসি এস এম মঈনুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। প্রথমত সাক্ষী হাজির করা যায় না। তবে বিষয়টি সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)।’

জয়পুরহাট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, কিডনিসংক্রান্ত বেশ কিছু মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের কেউ কারাগারে আছেন, আবার কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে এখনো কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।

l প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বগুড়া প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজ ও জয়পুরহাট প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম।