রোহিঙ্গারা কি মানবিক করিডর চান, কী ভাবছেন তাঁরা

কক্সবাজারের উখিয়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত ১৮ মার্চ তোলাছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডর’ গড়ার যে আলোচনা চলছে, তাতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তেমন আগ্রহ কিংবা সাড়া নেই। রোহিঙ্গা নেতাদের অভিমত, করিডরের আগে আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল (সেফজোন) গড়তে হবে। এ ছাড়া যে করিডরের আলোচনা চলছে, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, আগে যেমন মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈরী ছিল, তেমনি এখনো সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করছে।

গত সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতা, রাখাইন রাজ্য থেকে সদ্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবার, প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, মানবিক করিডরের বিষয়ে সরকারের ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ হয়েছে। তাঁর ওই বক্তব্যের সপ্তাহ না পেরোতেই সরকারের ভিন্ন অবস্থানের কথা জানান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। গত রোববার ঢাকার এক সেমিনারে খলিলুর রহমান বলেন, মানবিক করিডর কিংবা অন্য কিছু নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো চুক্তি হয়নি।

করিডর বিষয়ে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কাছেও কোনো তথ্য নেই। শরণার্থীবিষয়ক কমিশনার ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানবিক করিডর নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চললেও এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, করিডর প্রতিষ্ঠা এবং অধিকৃত রাখাইন অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির প্রশাসনে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্প্রতি আরাকান আর্মি অধিকৃত অঞ্চলে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের নিয়ে দলগত বৈঠক করছে। তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। উচ্ছেদ করা কিছু মানুষজনকে পুনরায় ঘরবাড়িতে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

করিডর নিয়ে রোহিঙ্গাদের অনীহা

রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গা নিজেদের কোনো লাভ দেখছে না। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। আর এ কারণে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ আগের মতোই অব্যাহত আছে। এই অবস্থায় মানবিক করিডর রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো উপকারে আসবে না।

রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটারির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, টানা ১১ মাসের যুদ্ধের পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকা (২৭১ কিলোমিটার) নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। কিন্তু পাঁচ মাসে অধিকৃত অঞ্চলটিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ ঘোষণা দিতে পারছে না তারা। কারণ, সেখানে প্রায় প্রতিদিন আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। রোহিঙ্গা নিধনও বন্ধ হয়নি। তা ছাড়া অধিকৃত এলাকায় চরম খাদ্য ও ওষুধের সংকট চলছে। মাদক, অস্ত্র চোরাচালান, চুরি-ডাকাতিও বাড়ছে। সবকিছু সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আরাকান আর্মি। এমন পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বাইরে রেখে করিডর কোনোভাবে সম্ভব হবে না।

আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের দাবি করে রোহিঙ্গা নেতা মো. জোবায়ের বলেন, সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর অধীনে একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে রাজি হবে না। গোষ্ঠীটি টিকে আছে মাদক ও পশু চোরাচালানের টাকায়। করিডর হলে চোরাচালান আরও বাড়বে।

রাখাইন রাজ্যের মৃদু টাউনশিপের দামনখালীর ১৫ হাজার বাসিন্দার চেয়ারম্যান (ওকাট্টা) ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা সিরাজ উল্লাহ। ২০১৭ সালের আগস্টে সামরিক জান্তার নির্যাতনে সপরিবারে পালিয়ে এসে টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। সোমবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জান্তা সরকারকে হটিয়ে মংডু টাউনশিপের পুরোটা আরাকান আর্মি দখল করলেও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। উল্টো দিনদিন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। দখলকৃত অঞ্চলটি নিয়ে গোষ্ঠীটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়া চেষ্টা করলেও নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৭ সালে সরকারি বাহিনীর নিপীড়নে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। একইভাবে আরাকান আর্মির অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে ১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার চেষ্টায় আছেন। সে ক্ষেত্রে করিডর কার জন্য, এ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১ মে পর্যন্ত গত কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে এসেছেন ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে আগে থেকে অবস্থান করছেন ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো না গেলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

আগে নিরাপদ অঞ্চল

রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে ৪০ জনের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে। প্রত্যাবাসনের আগে তাঁরা রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ বসবাসের জন্য নিরাপদ অঞ্চল (সেফজোন) চান। তাও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে।

শালবাগান আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা ফারুক আহমেদ (৫৫) বলেন, ‘আট বছর ধরে আমরা ( রোহিঙ্গারা) দাবি জানিয়ে আসছি, মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব দিলে রোহিঙ্গা ফিরে যেতে রাজি। এখন বলছি, আগে সেফজোন, তারপর প্রত্যাবাসন। কারণ, রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন মিয়ানমার সরকারের হাতে নেই।’

বর্তমানে শালবাগান আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪২ হাজার। ক্যাম্প ইনচার্জের দেওয়া তথ্যমতে, সম্প্রতি এই আশ্রয়শিবিরে নতুন করে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। তাঁরা আত্মীয়স্বজনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত ১৪ মার্চ উখিয়ার আশ্রয়শিবির পরিদর্শনে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ওই দিন বিভিন্ন রোহিঙ্গা কমিউনিটির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তখন রোহিঙ্গা নেতারা জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আগে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইন রাজ্যে সেফজোন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেদিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেফজোন না করলে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। সেফজোন কার্যকর করতে হলে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ ধরনের শান্তিরক্ষা বাহিনীকে তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি দেবে কি না, আবার দখলদার আরাকান আর্মি সেটাকে কীভাবে দেখছে—সেটাই দেখার বিষয়।