কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী চান্দেরচর গ্রামের গরু খামারি জয়নাল মিয়া। ঘরে বসে বিক্রির আশায় ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় পরিচালিত ‘কোরবানির পশুর ডিজিটাল হাট’ ফেসবুক পেজে তাঁর খামারের একটি গরুর ছবি আপলোড করেছেন। গরুটির জাত দেশি, রং কালো। ওজন ১২০ কেজি। যোগাযোগের জন্য খামারমালিক জয়নাল মুঠোফোন নম্বরও দিয়েছেন। এরই মধ্যে আপলোডের তিন দিন হয়ে গেল। কিন্তু কোনো ক্রেতা তাঁকে একবারের জন্যও মুঠোফোনে ‘হ্যালো’ বলেননি।
‘অনলাইন কোরবানির পশুর ডিজিটাল হাট, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ’ পেজে গতকাল সোমবার পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক গরুর ছবি আপলোড হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেবল জয়নাল মিয়া নন, হাতে গোনা কয়েকজন বাদে এখন পর্যন্ত কেউ তেমন সাড়া পাননি। এ অবস্থায় অনলাইনে গরু বিক্রি হবে—এমন আশা ছেড়ে দিয়ে কোরবানির পশু নিয়ে বিক্রেতারা হাটের দিকে ছুটছেন।
জয়নাল মিয়া বলেন, ‘ফেসবুকে ছবি দেওয়ার পর মনে হইছিল ফোন পামু। কিন্তু কোনো খবর নাই। শেষে আইজ (মঙ্গলবার) সকালে হাটে নিয়া বেইচ্ছা দিছি।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণ এড়াতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ‘কোরবানির পশুর ডিজিটাল হাট’ চালু করে। প্রযুক্তিনির্ভর এই হাট নিয়ে খামারিদের আগ্রহ থাকলেও কোনো বছর বিক্রিতে সাফল্য আসেনি। এখন করোনার প্রকোপ কমে গেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ডিজিটাল হাট নিয়ে সমান আগ্রহ প্রকাশ করে চলেছে। এবার ভৈরব উপজেলা পেজে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ছবি আপলোড শুরু হয়। মূলত মাঠকর্মীরা প্রথমে এই বিষয়ে খামারিদের সঙ্গে কথা বলেন। ডিজিটাল হাটে পশুর ছবি আপলোড করতে রাজি হলে তখন মাঠকর্মীরা ছবি তোলাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য যুক্ত করে পেজে আপলোড দিয়ে থাকেন।
আজ মঙ্গলবার ও আগের দিন সোমবার অন্তত ১৫ জন খামারির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা ডিজিটাল হাটে পশুর ছবি আপলোড দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের রাসেল মিয়া একজন। তিনি তিন দিন আগে গরুর ছবি আপলোড করেন। কেউ কি ফোন করল—এমন প্রশ্নে রাসেল মিয়া বলেন, ‘নারে ভাই, কেউ করে নাই। ঈদের আর দুই দিন বাকি। আর ভরসা করতে পারলাম না। এখন গরু হাটে নিয়া যাইতাছি।’
একই মন্তব্য ভৈরব পৌর শহরের জগন্নাথপুর আওয়ালকান্দা এলাকার খামারি রিয়াজ উদ্দিনের। ডিজিটাল হাটে সাড়া না পাওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ‘কোরবানির পশু কেনা হলো উৎসব। লোকজন হাটে যাবে। গরুর শিংয়ের গুঁতো খাবে। কাদামাটি মাড়িয়ে অনেক পশুর দামদর করে শেষে একটা কিনে নিয়ে আসবে। এই হলো আমাদের হাটের সংস্কৃতি। ডিজিটাল হাটে এসব নাই। ফলে ডিজিটাল হাট ক্রেতার নজর কাড়তে পারছে না।’
ডিজিটাল হাট নিয়ে খামারি ও ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ানো নিয়ে কাজ করছেন প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের অসংখ্য মাঠকর্মী। তাঁদের একজন পাপিয়া বেগম। তিনি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নে মাঠকর্মী। ডিজিটাল হাটের সাফল্য কতটুকু—এমন প্রশ্নে পাপিয়ার এক কথায় উত্তর, ‘আশাজাগানিয়া নয়।’ পরে বলেন, তবে খামারিদের আগ্রহ বাড়ছে। একসময় ডিজিটাল হাটের কথা বললে খামারিরা ভ্রু কুঁচকাতেন। ছবি তুলতে দিতেন না। প্রয়োজনীয় তথ্য দিতেও গড়িমসি করতেন। এখন এমন মানসিকতা থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলতে দেন। খোলামেলা কথা বলেন।
চার বছরেও ডিজিটাল পশুর হাট ক্রেতাদের আগ্রহের জায়গা তৈরি করতে পারেনি। কারণ জানতে কথা হয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, পশুর হাটের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ অনেক। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আগ্রহে ভাটা পড়ে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে এসে। এখনো কর্মরতদের বেশির ভাগ বিষয়টিকে অতিরিক্ত কিংবা অহেতুক কাজ মনে করেন। এই অবস্থায় প্ল্যাটফর্মকে ক্রেতাপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ হচ্ছে না। প্রথম বছর ২০২০ সালে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পশু বিক্রি হয়েছে কয়েকটি। দ্বিতীয় বছর বিক্রি হয়েছে মাত্র একটি। গত বছরের বিক্রির হিসাব নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এই বছরও বিক্রির সংখ্যা শূন্য থেকে যেতে পারে।
ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান তরফদার ডিজিটাল হাটের সমন্বয়ক। গতকাল তাঁকে কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। সেই কার্যালয়ে কথা হয় ভেটেরিনারি সার্জন সাইফুল আজমের সঙ্গে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে তাঁর মন্তব্য হলো, বিশেষ পরিস্থিতিতে (করোনা) ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে হাট চালুর প্রসঙ্গটি আসে। এখন হয়তো পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি আরও সক্রিয় করা প্রয়োজন। তাঁরা কাজ করছেন। খামারিদেরও আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ানো যাচ্ছে না।