আশ্রয়কেন্দ্র খোলার আহ্বান জানিয়ে নিজেই পানিতে ডুবে মারা গেলেন

জুনায়েদুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

মানুষের বিপদ দেখলে ছুটে যেতেন এক তরুণ। সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার করতেন। গত সোমবার রাতে ভারী বর্ষণ ও অস্বাভাবিক জোয়ারে যখন চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছিল, তখন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি পরিস্থিতির অবনতির কথা বলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান। এরপর নিজের বাড়িতে পানি ওঠায় পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয়ে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। এর আগেই পানিতে পড়ে যাওয়া ফুফাতো ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান তিনি।

মারা যাওয়া ওই তরুণের নাম জুনায়েদুল ইসলাম (২২)। পড়তেন বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। জুনায়েদুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের জনকল্যাণ এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। জুনায়েদুলের বাবা জুলফিকার আলী বাড়ির পাশে একটি ছোট স্টেশনারি দোকান করেন। মা মরিয়ম বেগম আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। মা–বাবার একমাত্র সন্তান জুনায়েদুল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মা–বাবা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে জুনায়েদুলের লাশ উদ্ধার করা হয়।

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ জুনায়েদুল ইসলামের মা মরিয়ম বেগম(ডানে)। আজ বুধবার সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার জনকল্যাণ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জুনায়েদুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, বসতঘরে পানি ঢুকে পড়ায় সোমবার গভীর রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য বের হন জুনায়েদুল ইসলাম। বাড়ি থেকে বের হতেই পানির স্রোতে ডুবে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

আজ বুধবার সকালে জুনায়েদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের বসতঘরে এখনো পানি। এ কারণে পাশেই এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন জুনায়েদুলের মা–বাবা। সেখানে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ মা মরিয়ম বেগম। কথা বলতে পারছেন না। শুধু কাঁদছেন।

ওই বাড়ির উঠানে কথা হয় জুনায়েদুলের বাবা জুলফিকার আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি বাড়তে শুরু করে। বসতঘর ছেড়ে নিরাপদে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন জুনায়েদুল। কিন্তু বাড়িতে ফুফু-ফুফা, দুই ফুফাতো ভাইসহ চারজন অতিথি থাকায় দ্রুত বসতঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। সন্ধ্যার সময় জুনায়েদুলদের টিনশেডের বাড়িতে পানি উঠে যায়। রাত ১১টার দিকে জুনায়েদুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কথা লিখে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান। রাত ১২টার দিকে স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। তখন তাঁদের বসতঘরে হাঁটুসমান পানি।

মসজিদের মাইকে সতর্কবার্তা পাওয়ার পর জুনায়েদুল পরিবার নিয়ে বসতঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জুনায়েদুলদের বসতঘর থেকে গ্রামীণ সড়কটি ১০০ মিটার দূরে। বসতঘরের পরেই পানির উচ্চতা ছিল ১৫ ফুট। ছিল তীব্র স্রোত। সাতার জানতেন না জুনায়েদুল। পরিবারকে নিরাপদে নিয়ে যেতে প্রতিবেশী দুই তরুণের সাহায্য নেন জুনায়েদুল।

ওই দুই তরুণের একজনের নাম মহিউদ্দিন। প্রথমে আলোকে মহিউদ্দিন বলেন, ‘সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে একটি টিউবের সাহায্যে আমরা প্রথমে জুনায়েদুলের মাকে পার করি। তারপর নিরাপদে পার করি তাঁর ফুফুকে। একপর্যায়ে সাতরে পার হওয়ার জন্য জুনায়েদুলের এক ফুফাতো ভাই ঘর থেকে পানিতে লাফ দেন। পানিতে প্রবল স্রোত থাকায় তিনি পানিতে তলিয়ে যেতে থাকেন। ফুফাতো ভাইকে বাঁচাতে সাতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে ঝাঁপ দেন জুনায়েদুল। তাঁর ফুফাতো ভাইকে আমরা উদ্ধার করতে পারলেও পানিতে ডুবে যান জুনায়েদুল।’

আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জুনায়েদুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজের পর স্থানীয় বাসিন্দারা জুনায়েদুলকে উদ্ধারে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হন। পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলেও গাছ পড়ে সড়ক বন্ধ থাকায় তারা আসতে পারেনি। পরে গতকাল বেলা ৩টার দিকে নিখোঁজের ১৩ ঘণ্টা পর বাড়ি খেকে ২০ ফুট দূরে একটি গাছের শিকড়ে আটকে থাকা অবস্থায় তাঁর লাশ খুঁজে পান স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল মাগরিবের নামাজের পর জানাজা শেষে স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে জুনায়েদুলের লাশ দাফন করা হয়।

প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না

জুনায়েদুল ইসলামের দাদা খোরশেদ আলম ছিলেন প্রকৌশলী। দাদার মতো প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন ছিল এই তরুণের। কিন্তু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ায় তাঁর সেই স্বপ্ন আর কোনো দিনই পূরণ হবে না।

জুনায়েদুল মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলে জানান তাঁর মামা ইয়াছিন আরাফাত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘৩ আগস্ট জুনায়েদুলের জন্মদিন ছিল। ২ আগস্ট তার প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশিত হয়। সেই পরীক্ষার ফলাফল ভালো হওয়ায় জন্মদিনে আমার কাছে উপহার দাবি করে জুনায়েদুল। কিন্তু বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় সেই উপহার দিতে পারিনি।’

জুনায়েদুলের ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ছাত্র-মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান।

লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জুনায়েদুল ইসলাম ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ নিতেন। যেকোনো দুর্যোগে মানুষের সেবায় ছুটে যেতেন। করোনাকালেও মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন।