জয়পুরহাটে মেয়েদের ফুটবল খেলা ঘিরে মাঠে ভাঙচুরের ঘটনায় গণশুনানি, ক্ষমা প্রার্থনা

জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল খেলা ঘিরে মাঠে ভাঙচুরের ঘটনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির গণশুনানি। শনিবার দুপুরে আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজন কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ লোকজনের মাঠে ভাঙচুরের ঘটনায় গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শনিবার বেলা ১১টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

গণশুনানিতে ভাঙচুরের ঘটনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা নারীদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজক কমিটি, স্থানীয় আলেম-ওলামা, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা ও উপজেলার প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। শুনানিতে ওই ঘটনার জন্য মুসল্লিদের পক্ষে তিলকপুর পুরাতন বাজার জামে মসজিদের খতিব আবদুস সামাদ ও বাচ্চা হাজি মাদ্রাসার পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক ক্ষমা চান।

উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত এ গণশুনানিতে অংশ নেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দেবী চন্দ, অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব) মনির হোসেন। এ সময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম, আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

উপসচিব দেবী চন্দ প্রথমে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় টি স্টার ক্লাবের সভাপতি বিএনপি নেতা সামিউল হাসান, সাধারণ সম্পাদক খাজা মণ্ডল, তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুনুর রশিদ, তিলকপুর পুরাতন বাজার জামে মসজিদের খতিব আবদুস সামাদ ও বাচ্চা হাজি মাদ্রাসার পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিকের কথা শোনেন। ভাঙচুরের ঘটনার জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে আবদুস সামাদ ও আবু বক্কর সিদ্দিক দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁরা নারী ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে বাধা দেবেন না বলে জানান।

গণশুনানির একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা ছাত্র প্রতিনিধি হাসিবুল হক তাঁর বক্তব্যে একপর্যায়ে খেলার মাঠে ভাঙচুরের ঘটনায় প্রথম আলোকে ‘দালাল’ সম্বোধন করেন। সঙ্গে সঙ্গে শুনানিতে অংশ নেওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এর প্রতিবাদে গণমাধ্যমকর্মীরা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহীউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও ইউএনও মনজুরুল আলমের অনুরোধে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে ছাত্র প্রতিনিধি হাসিবুল হক ওই কথা বলার জন্য প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর তদন্ত কমিটির প্রধান দেবী চন্দ গণমাধ্যমকর্মীদের বক্তব্য শোনেন।

গণশুনানিতে উপসচিব দেবী চন্দ বলেন, ২৮ জানুয়ারির ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। তাঁরা সরেজমিন তদন্তের জন্য এখানে এসেছেন। তাঁরা সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে গণশুনানি করছেন। গণশুনানিতে তাঁরা সবার কথা শুনেছেন। এতে যেটা বুঝেছেন, মেয়েদের খেলাধুলা বন্ধ করার আসলে কোনো উদ্দেশ্য নেই। এটা চমৎকার সম্প্রীতির এলাকা। যেখানে ছেলে-মেয়ে উভয়ের ট্যালেন্টকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে।

দেবী চন্দ বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। যাঁদের মাধ্যমে ঘটেছে, তাঁরা এখানে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটা প্রথমেই হয়তো সুন্দরভাবে সমাধান করা যেত। যা–ই হোক, যায়নি বলে কখনো সমাধান করা যাবে না, তা-ও নয়। এটা সমাধানের জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এসেছি। সবাই খেলাধুলার পক্ষে। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করব।’

আক্কেলপুরের তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে টিন দিয়ে ঘেরাও করে ছেলেদের ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে স্থানীয় টি-স্টার ক্লাব। ছেলেদের টুর্নামেন্ট চলাকালে ওই মাঠে ২৯ জানুয়ারি (বুধবার) জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের মধ্যে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করেন আয়োজকেরা। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হন আলেম সমাজ ও স্থানীয় একদল মানুষ। তাঁরা মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধের দাবি জানিয়ে ২৮ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) বিকেলে তিলকপুর রেলস্টেশনের সামনে জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে এসে খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুর করেন। এ নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ভাঙচুরের প্রতিবাদে মানববন্ধন

মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে আপত্তি ও মাঠে ভাঙচুরের প্রতিবাদে জয়পুরহাট শহরে মানববন্ধন করেছেন খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকেরা। আজ শনিবার দুপুর ১২টায় শহরের জিরো পয়েন্ট-পাঁচুরমোড়ে জেলার খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকদের ব্যানারে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

ঘণ্টাব্যাপী চলা মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান (চন্দন), অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া কর্মকর্তা আবু মহিউদ্দিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল ওহাব, ক্রীড়া সংগঠক আসিফ শাহরিয়ার, সামশ মতিন, নারী ফুটবলার রিতু আকতার প্রমুখ বক্তব্য দেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, নারীরা খেলতে চান। তাঁদের খেলা বন্ধ করা ঠিক নয়। অবিলম্বে নারী খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে খেলার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। বক্তারা তিলকপুরে বন্ধ হওয়া মেয়েদের খেলা আয়োজনের দাবি জানান।