সবজি বেচে কোনোমতে খরচ ওঠে কৃষকের, হাতবদলে দাম বাড়ে কয়েক গুণ
উত্তরাঞ্চলে সবজির অন্যতম বড় পাইকারি মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাট। সেখানে গতকাল শনিবার এক কেজি শসা বিক্রি করে কৃষক দাম পেয়েছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা। হাতবদলের পর বগুড়া শহরের শাহ ফতেহ আলী বাজারে খুচরা পর্যায়ে সেই শসা ক্রেতারা কিনেছেন ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ খুচরা বাজারে শসা বিক্রি হয়েছে পাইকারি বাজারের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে।
সবজি উৎপাদনে জড়িত কৃষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেল, সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় সবজি উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। খেত থেকে সবজি তুলে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে তাঁরা যে দাম পাচ্ছেন, তাতে কোনোরকমে উৎপাদন খরচ উঠছে। আর খুচরা বাজারে সেই সবজি দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।
খরিপ মৌসুমে চার বিঘা জমিতে নানা জাতের সবজি চাষ করেছিলেন গাবতলী উপজেলার চককাতুলীর মিঠু চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, সার, কীটনাশক ও সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় বাজারে সবজির দাম মিলছে না। এক কেজি শসা হাটে নিয়ে দাম মিলছে সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২০ টাকা।
বগুড়া সদরের ধাওয়াকোলার সবজিচাষি উজ্জ্বল হোসেন বলেন, গত বছর ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৬ টাকা বৃদ্ধি করায় সেচ খরচ বেড়েছে। বেড়েছে হালচাষসহ উৎপাদন ও পরিবহন খরচও। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে খেত থেকে মহাস্থান হাট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথে পরিবহন খরচ ছিল প্রতি মণ ২০ টাকা। এখন তা ৩৫ টাকায় উঠেছে।
গতকাল বগুড়ার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেল, হাটে প্রচুর সবজির আমদানি। ক্রেতা-ব্যাপারীর হাঁকডাকে সরগরম হাট। অনেকটা সস্তা দামে সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলছেন কৃষক। অথচ হাতবদলের পর সেই সবজি খুচরা বাজারে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে এক কেজি কাঁচা মরিচ ৯০ টাকা, কচুমুখি ৮০, গোল বেগুন ২৪, লম্বা বেগুন ৩২, ঢ্যাঁড়স ১৭, হাইব্রিড করলা ৩০, মুলা ২০, বরবটি ২৫, পটোল ২২, ঝিঙে ২০, ফুলকপি ৬০, পেঁপে ২৮, মিষ্টিকুমড়া ২০, জালি কুমড়া প্রতিটি ২০, পাকড়ি লাল আলু ৩৫ ও সাদা আলু ২৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
বগুড়ার ফতেহ আলী বাজারে খুচরা পর্যায়ে গতকাল বিকেলে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১২০ টাকা, গোল বেগুন ৭০, লম্বা বেগুন ৬০, ঢ্যাঁড়স ৩২, করলা ৭০, মুলা ৪০, বরবটি ৬০, পটোল ৪০, ঝিঙে ৫০, ফুলকপি প্রতি কেজি ১০০, পেঁপে ৭০, মিষ্টিকুমড়া ৪০, জালি কুমড়া প্রতিটি ৪০, লাল পাকড়ি আলু প্রতি কেজি ৫০ এবং সাদা অ্যাসটরিক আলু প্রতি কেজি ৪০, পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
গত বছর জুনে মহাস্থান হাটে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৩২, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা, পটোল ২০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ২০, মুলা ২০, কচুমুখি ২২, মিষ্টিকুমড়া ২০, শসা ৩৫, করলা ৪০, পেঁপে ৯, দেশি লাল পাকড়ি আলু ২৫, সাদা আলু ২০, জালি কুমড়া প্রতিটি ১৮ টাকা এবং ছাচি লাউ প্রতিটির দাম ৩০ টাকা ছিল।
গতকাল সকালে প্রখর রোদে ৪০ কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি করতে মহাস্থান হাটে এসেছিলেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক মেহের আলী। তিনি বলেন, ‘খ্যাতের এক কেজি পত্তে (মরিচ) বেচে দাম পাচ্চি ৮০ টেকা। হামাকেরে কাছ থ্যাকে এই পত্তে কিনে শহরত লিয়ে বেচা হচ্চে ১৪০ টেকা কেজি।’
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ছয়ঘড়িয়া কৃষ্ণপুর গ্রামের তফিজার রহমান হাটে ৫ মণ করলা বিক্রি করতে এসেছেন। তিনি বলেন, গত বছর এই সময়ে এক কেজি করলা বিক্রি করেছেন ৩০ টাকা কেজি। সেই করলার দাম এই বারও ৩০ টাকাই আছে। অথচ সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বেড়েছে, খরচও ঠিকমতো উঠছে না।
মহাস্থান হাটের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর হাটে সবজির যে পরিমাণ আমদানি ছিল, এবারও সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। তবে জ্বালানির দাম বাড়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনীসহ বিভিন্ন পাইকারি মোকামে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। মহাস্থান হাটের পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা কেজি দরে যে পেঁপে বিক্রি করছেন কৃষকেরা, শুধু হাতবদলের পর বগুড়া শহরের খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাকে এই পেঁপে কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে। অথচ এক কেজি পেঁপে মহাস্থান হাট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পরিবহন, আড়তদারি কমিশন, হাটের খাজনাসহ খরচ গড়ে সর্বোচ্চ দুই টাকা। এক বছর আগে পরিবহন খরচ ছিল গড়ে এক টাকা।
মহাস্থান হাট থেকে ট্রাকে নিয়মিত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সবজি পরিবহনে করেন স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী খাজা মিয়া। তিনি বলেন, বগুড়া থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১৫ টন সবজি পরিবহনে এক বছর আগে ভাড়া ছিল গড়ে ১৮ হাজার টাকা। এখন ভাড়া ৩৪ হাজার টাকা।
ট্রাকমালিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মহাস্থান থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রাক যাতায়াতে ডিজেল খরচ হয় ২৫ লিটার। তেল-মবিলের সঙ্গে আরও আছে টায়ার-টিউব খরচ, চালক-সহকারীদের বেতন এবং পথের খরচাপাতিও বেড়েছে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে পণ্য পরিবহনে ভাড়া মিলছে গড়ে ৪৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে আসা-যাওয়া মিলে গড়ে ৭ হাজার টাকা লাভ হয়।
মহাস্থান হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী শাহাদৎ হোসেন বলেন, ১৪ টন সবজি পরিবহনে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ভাড়া ছিল আগে ১৮ হাজার ও ১৬ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর এখন ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৩৪ হাজার ও ২৪ হাজার টাকা। পরিবহন ছাড়াও হাটের টোল খরচ, বস্তাজাত করার শ্রমিক খরচ, কুলি খরচ—সব বেড়েছে। এতে সবজি পরিবহন খরচও বেড়েছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতলুবর রহমান বলেন, এবার রেকর্ড জমিতে শীতকালীন সবজি উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া খরিপ মৌসুমেও রেকর্ড সবজি চাষাবাদ হয়েছে। এ মৌসুমে ৫৫ লাখ ৭৫০ হেক্টর জমিতে ১২ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। সবজি ও আলুর বাজারদর বাড়ার জন্য কৃষক দায়ী নন, লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। হাটে সবজি বিক্রি করে কৃষক কোনোরকমে খরচ তুললেও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হাতবদলের পর সবজির দাম কয়েক গুণ বাড়ছে।