মরতে বসেছে মুক্তেশ্বরী নদী 

কমপক্ষে ১৬ ফুট উচ্চতার সেতু নির্মাণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এলজিইডি তা না মেনে ৪ দশমিক ৫৯ ফুট উচ্চতার সেতু নির্মাণ করছে।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদীতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে চলছে সেতু নির্মাণের কাজ
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের মনিরামপুরে মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর একটি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সেতুর পাইল বসানোর জন্য নদীতে দেওয়া হয়েছে একটি আড়াআড়ি মাটির বাঁধ। পানিপ্রবাহ সচল রাখতে বাঁধের এক পাশে মাত্র ১০ ফুট জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। এতে নদীর পানির প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া সেতুটির নকশায় উচ্চতা প্রয়োজনের চেয়ে খুব কম রাখা হয়েছে। সেতুটি নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনাপত্তিপত্র নেওয়ার শর্ত থাকলেও তা নেয়নি এলজিইডি।

পরিবেশবাদী ও নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিচু সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সেতুর নিচ দিয়ে নদীতে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারবে না। তা ছাড়া সেতু নির্মাণের জন্য এভাবে নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া নদী হত্যার শামিল। কারণ, পরে বাঁধ কেটে দেওয়া হলেও নিচে ভরাট হওয়ার কারণে নদীতে আর আগের পানির প্রবাহ ফেরে না।

নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ থেকে মুক্তেশ্বরী সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। 
মোহাম্মদ আশ্রাফ উদ্দীন, বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা

বিআইডব্লিউটিএ খুলনার পশ্চিম বদ্বীপ শাখার নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশ্রাফ উদ্দীন বলেন, নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ থেকে মুক্তেশ্বরী সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।  এ জন্য এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।

উপজেলার হাজরাইল এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে এ সেতু। ১০ ও ১২ জানুয়ারি দুই দফা সেতু এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও সেতু নির্মাণবিষয়ক কোনো সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি। মনিরামপুর উপজেলার কাটাখালী গ্রামের পশ্চিম অংশে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে মুক্তেশ্বরী নদী। নদী ভরে আছে কচুরিপানায়। ওই গ্রামে নদীর ওপর ৫৪ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু আগে থেকেই রয়েছে। ২০০৯ সালে এলজিইডি নির্মিত ওই সেতুটি আরও নিচু। ওই সেতুর প্রায় ৪০০ মিটার দক্ষিণে নদীর পশ্চিম পাশে হাজরাইল এবং পূর্ব পাশে কাটাখালী গ্রাম। এখানে নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন সেতু। এ জন্য নদীতে আড়াআড়িভাবে প্রায় ১৫০ ফুট দীর্ঘ মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধটি প্রায় ৪০ ফুট প্রশস্ত। বাঁধের পশ্চিম দিকে ১০ ফুটের মতো জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। বাঁশের চাটি দিয়ে পাটাতন তৈরি করে ওই ফাঁকা জায়গা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বাঁধের মাঝখানে কয়েকজন শ্রমিক লোহার রড দিয়ে গোলাকার খাঁচা তৈরি করছেন। পশ্চিম পাশে কয়েকজন শ্রমিক যন্ত্র দিয়ে পাইলিংয়ের কাজ করছেন। সর্বশেষ গিয়ে দেখা গেছে, পাইলিংয়ের কাজ শেষ। কাজ এখন বন্ধ।

মনিরামপুরের এলজিইডি সূত্র জানায়, যশোর অঞ্চল গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (জেআরআরআইডিপি) আওতায় নতুন এ সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৫০ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৫ মিটার। সেতুর উচ্চতা হবে ১ দশমিক ৪ মিটার (৪ দশমিক ৫৯ ফুট)। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৭ টাকা। কাজ পেয়েছে খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অর্পি অর্ণি এন্টারপ্রাইজ। গত ৩ আগস্ট সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি এর কাজ শেষ হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩-এর ধারা ২০-এর (১) অনুযায়ী, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা, কোনো জলাধারে, তীরবর্তী হোক বা না হোক, স্থাপনা নির্মাণ করে বা জলাধার ভরাট করে বা জলাধার থেকে মাটি বা বালু উত্তোলন করে জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা তার প্রবাহে বাধা সৃষ্টি বা তার গতিপথ পরিবর্তন বা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারবে না।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অর্পি অর্ণি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘নদীতে ৯ ফুট পানি আছে। ৬ ফুট পানির নিচে ৩৮টি পাইল বসাতে হয়েছে। এ জন্য নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। পাইলের কাজ শেষ। আপাতত সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে পুনরায় কাজ শুরু করব। বর্ষা মৌসুমের আগে নদীর ভেতরের কাজ শেষ করে বাঁধ কেটে দেওয়ার চেষ্টা করব।’

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী নৌপথে খুঁটিসহ বৈদ্যুতিক লাইন ও সেতু নির্মাণ করতে হলে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র (নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স) নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই বিধিমালায় নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী, দেশে প্রথম শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে সেতুর উচ্চতা হবে কমপক্ষে ৬০ ফুট, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪০, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ ও চতুর্থ শ্রেণির নৌপথে অন্তত ১৬ ফুট উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করতে হবে।

বিআইডব্লিউটিএর তালিকায় মুক্তেশ্বরী নদীটি চতুর্থ শ্রেণির। সেই হিসাবে এখানে কমপক্ষে ১৬ ফুট উচ্চতার সেতু নির্মাণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এলজিইডি তা না মেনে ৪ দশমিক ৫৯ ফুট উচ্চতার সেতু নির্মাণ করছে।

নদীতীরের বাসিন্দা হাজরাইল গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘মুক্তেশ্বরী নদী মরতে বসেছে। ব্রিজ করার জন্য নদীর মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। এখন বাঁধের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছি। কিন্তু নদী শেষ।’

জানতে চাইলে মনিরামপুর উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস বলেন, মুক্তেশ্বরী নদীতে পানিপ্রবাহ নেই। কোনো নৌযান চলে না। তা ছাড়া সেতুর নকশা আগের। এ জন্য বিআইডব্লিউটিএর ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাঁরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, নদীর মধ্যে মাটির বাঁধটি সাময়িক। পাইলিং কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাঁধ কেটে দেওয়া হবে।