চট্টগ্রামের সিআরবির শিরীষতলায় উৎসুক লোকজনের জটলা। সবাই তাকিয়ে একটা পরিত্যক্ত ভবনের দেয়ালের দিকে। কেউ কেউ ছবিও তুলছিলেন। শিরীষতলার মাঠের শেষ প্রান্তে বিশাল রেইনট্রিগাছের পেছনে রেলওয়ের পরিত্যক্ত একতলা অফিস ভবন। তার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে একটা গ্রাফিতি। ২০ ফুট লম্বা আর প্রায় ১২ ফুট উঁচু সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া দেয়াল। সেখানে একটা গাধার পিঠে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন একজন ‘ভাবুক’। ‘ভাবুকটি’ আবার যে-সে নয়। বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর আগুস্ত রোঁদ্যার (১২ নভেম্বর ১৮৪০—১৭ নভেম্বর ১৯১৭) ‘দ্য থিংকার’ ভাস্কর্যের প্রতিরূপ। ছবির পেছনে রোমান হরফে একটা লোগো ‘হবেকি’ (HOBEKI?)।
গতকাল শনিবার সকালে শিরীষতলায় হাঁটতে আসা লোকজনের মুখে মুখে ফিরছিল নতুন এই গ্রাফিতির কথা। ২০১৭ সালে ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে ‘সুবোধ’ শিরোনামের গ্রাফিতি সারা দেশে শিল্পবোদ্ধা এবং রাজনীতিসচেতন মানুষের নজর কাড়ে। সুবোধ সিরিজের প্রতিটি গ্রাফিতির সঙ্গেই দেওয়া হয়েছিল হবেকি (HOBEKI?) লোগো।
ঢাকার পর হবেকি লোগোযুক্ত গ্রাফিতি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে দেখা গেল। এখানকার শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধারা বলছেন, ঢাকার দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ আর চট্টগ্রামের সিআরবির দেয়ালে আঁকা ‘ভাবুকের’ ছবি একই শিল্পীর আঁকা। গ্রাফিতি শিল্পীদের রীতি অনুযায়ী এসব শিল্পকর্মের স্রষ্টাও নিজের নাম গোপন রেখেছেন।
বরাবরের মতোই গভীর সমাজভাবনা ও রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছে হবেকির সর্বশেষ এই গ্রাফিতি। সেটা কীভাবে? ‘থিংকার’ বা ‘ভাবুক’ ভাস্কর্যের ব্যবহারেই তার ইঙ্গিত রয়েছে। বিখ্যাত এই ভাস্কর্য জ্ঞান বা দর্শনের রূপক হিসেবে পরিচিত বিশ্বজুড়ে। একই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদেরও প্রতীক এটি।
তাই গাধার পিঠে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বসিয়ে ভিন্ন এক তাৎপর্য আনতে চেয়েছেন শিল্পী। তীব্র বিদ্রূপে ভরা এই চিত্রে দেখানো হয়েছে সূক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী লোকজন বস্তুত বসে আছেন গাধার পিঠে। অর্থাৎ ‘ভাবুকদের’ ভরসা গাধার বুদ্ধির ওপর, গাধা যেখানে নিয়ে যাবে, সেটিই তাদের গন্তব্য।
চট্টগ্রামের দেয়ালে হবেকির এটিই প্রথম গ্রাফিতি বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ভাস্কর অলক রায়। নতুন এই গ্রাফিতিকে দেশের শিল্পজগতের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করেন তিনি। গ্রাফিতির বিষয়বস্তু নিয়ে জানতে চাইলে অলোক রায় বলেন, বর্তমানে দেশের দিশাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে তুলে ধরতে চেয়েছেন শিল্পী। দেশ যেদিকে যাচ্ছে যাক, ভাবুকেরা ভাবনায় নিমজ্জিত। কোনো ক্রিয়াশীলতা নেই।
সিআরবি এলাকার শিরীষতলায় নিয়মিত আসেন, এমন লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, শুক্রবার সকাল থেকে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে এই ছবি। তাঁরা মনে করছেন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এই ছবি আঁকা হয়েছে। বিশাল রেইনট্রির পটভূমি ও পেছনের আকাশের কারণে নতুন এই গ্রাফিতির সৌন্দর্য বেড়ে গেছে অনেকখানি। শিরীষতলায়
এলে দূর থেকেই চোখে পড়ছে দেয়ালজোড়া এই শিল্পকর্ম। চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক জিহান করিম জানালেন, যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতিশিল্পী ব্যাঙ্কসির মতোই স্ট্যানসিলে আঁকা হয়েছে গ্রাফিতিটি। এটি ভীষণভাবেই সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবনাযুক্ত একটি স্ট্রিট আর্ট। চট্টগ্রামের মতো শহরের জন্য এটি মূল্যবান একটি শিল্পকর্ম।
জিহান করিম আরও জানান, এই শিল্পকর্মে শিল্পী বর্তমান সমাজের অগ্রগতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
শিরীষতলায় গ্রাফিতি দেখছিলেন মারুফ রায়হান নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। গ্রাফিতি দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত। মারুফ বললেন, যুক্তরাজ্যের কোনো শহরে ব্যাঙ্কসি নতুন গ্রাফিতি করলে নগর কর্তৃপক্ষ সেটি প্রচার করে। ওই এলাকা রীতিমতো পর্যটনের স্থানে পরিণত হয়। তাই হবেকির এই শিল্পকর্মও সংরক্ষণ করা উচিত।
শিল্পবোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে এ দেশে প্রথম গ্রাফিতি লেখেন আইজুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ ঢাকার দেয়াল থেকে গণমানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছিল। দেয়ালে দেয়ালে দাবিনামার সঙ্গে তখন মানুষ আইজুদ্দিনের নাম জুড়ে দিত। ‘বেকারদের চাকরি দাও’, এমন দাবির পরিশেষে লেখা হলো ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’। শোনা যায়, আইজুদ্দিন রিকশাচালক ছিলেন। তাঁর মনের দুঃখ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে এভাবে সাধারণ মানুষের কষ্টের ভাষায় পরিণত হলো। অর্থাৎ গ্রাফিতি গণমানুষের মনের কথা হয়ে ওঠে বা মনের কথাই বলে।
২০১৭ সালের দিকে ‘হবেকি’ নামে গ্রাফিতিশিল্পী বা শিল্পীরা জন্ম দিলেন সুবোধ সিরিজের। একটা খাঁচায় বন্দী সূর্য নিয়ে আলুথালু চুলের এক তরুণ পালিয়ে যাচ্ছে কোথাও। স্ট্যানসিলে আঁকা এই ছবির পাশে লেখা হলো, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’। আবির্ভাবের পরপরই আলোচনায় এসেছিল সুবোধ। প্রথম আলোয় সেই সময় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছিল, ‘সুবোধ কেন পালাচ্ছে’। এরপর সময় যতই প্রতিকূল হয়েছে, সুবোধ হাজির হয়েছে দেয়ালে। ‘সুবোধ কবে ভোর হবে’, এমন প্রশ্নে সবাক হয়েছে ঢাকার দেয়াল। দেশের এই পটপরিবর্তনের সময়ে হবেকির এই শিল্পকর্ম আবারও দেশের বোদ্ধামহলে গভীর ভাবনা উসকে দেবে সন্দেহ কী।