‘যে মশা, এমনিই স্মার্ট হইয়া গেলাম কামড় খাইতে খাইতে’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাছে মশা মারার পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। তাই বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নগরে মশার উপদ্রব অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। মশার কামড়ের যন্ত্রণায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে কষ্ট হচ্ছে মানুষের।
নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়ে চলছে। এসবের ব্যয় সামাল দিতে সাধারণ মানুষ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে মশা মারার ওষুধ ও উপকরণ কিনতে। এমনিতেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ, সেখানে সিটি করপোরেশনের গাফিলতির কারণে আলাদা খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পাতায় মশা নিয়ে নিজেদের ক্ষোভ ও হতাশা তুলে ধরছেন নগরবাসী। মশা নিয়ে এমন পরিস্থিতিকে বিব্রতকর বলছেন খোদ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ নেই, থমকে আছে মশকনিধন কর্মসূচি
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের কাছে এখন মশা মারার পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তাঁদের কাছে এখন উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ (অ্যাডাল্টিসাইড) আছে দুই হাজার লিটার এবং লার্ভা নিধনের ওষুধ (লার্ভিসাইড) আছে এক হাজার লিটার, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তবে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় আড়াই মাস ধরে তাঁদের কাছে নতুন করে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ওয়ার্ড কার্যালয়ে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর দেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি করপোরেশনের এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা ওষুধ পাচ্ছেন না। এখন মশার যেভাবে উৎপাত বেড়েছে, সেভাবে ব্যাপক হারে মশার ওষুধ ছিটানো যাচ্ছে না। যেটুকু ওষুধ আছে, তা এলাকার মানুষ অনুরোধ করলে তখন লোক পাঠিয়ে ছিটানো হয়। কিন্তু এভাবে তো আসলে মশার উপদ্রব কমানো যাবে না।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মীরা জানান, পর্যাপ্ত ওষুধ ছিটাতে গেলে প্রতিটি ওয়ার্ডে মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই শ লিটার অ্যাডাল্টিসাইডের প্রয়োজন। চট্টগ্রাম নগরে ওয়ার্ড আছে ৪১টি। অর্থাৎ মাসেই নগরে অন্তত ১০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধের চাহিদা রয়েছে। আর লার্ভিসাইড লাগে পুরো নগরে মাসে ৭০ থেকে ৮০ লিটার।
মূলত, ওষুধ কেনার ক্রয়প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। মশার উৎপাত বছরজুড়ে থাকল ওষুধ কেনায় স্বচ্ছ কোনো ক্রয় পরিকল্পনা ছিল না সিটি করপোরেশন। মশার উপদ্রব যখন বেশি বৃদ্ধি পেত, তখন জরুরি পরিস্থিতি দেখিয়ে একজন নির্দিষ্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে ওষুধ নিত সিটি করপোরেশন। ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে এভাবে ওষুধ কেনায় ‘অনিয়ম’ খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সিটি করপোরেশন গত বছরের জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বর দুই দফায় ছাত্রলীগ নেতা অরভিন সাকিবের প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেঙ্গল মার্ক ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে ৬ হাজার ৩৫০ লিটার মশা মারার ওষুধ কেনে। এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে কেনা হয়েছিল ৬ হাজার ৪০০ লিটার ওষুধ। এসব ওষুধের জন্য সিটি করপোরেশনের ব্যয় হয় ৭৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
এদিকে গত বছরের নভেম্বরে দরপত্রের মাধ্যমে ১৫ হাজার অ্যাডাল্টিসাইড, ৫ হাজার লার্ভিসাইড, ২০টি ফগার মেশিন ও ১০০টি স্প্রে মেশিন কেনার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। কিন্তু ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিলেও তাদের যথাযথ অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ওষুধ নেওয়ার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আবার নতুন করে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সিটি করপোরেশন। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১২ মার্চ।
সিটি করপোরেশনের ক্রয় শাখার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বিপ্লব দাশ প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওষুধ কিনতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে। ওষুধ কেনা হয়ে গেলে এখন যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা আর থাকবে না।
মেয়রের ফেসবুক পাতায় নগরবাসীর ক্ষোভ
মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ প্রকাশ করে চলছেন ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। এমনকি সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পাতায়ও মশা নিয়ে বিরক্তির কথা তুলে ধরছেন তাঁরা।
সিটি মেয়র ১ মার্চ চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘চট্টগ্রামকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে নগরবাসীর সহযোগিতা চাই’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন। এই লেখা মেয়র নিজের ফেসবুক পাতায় শেয়ার করেন। এতে ১২ জন মন্তব্য করেন। এর সাতজনই মশা নিয়ে নিজেদের যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন। আমির হোসাইন নামের একজন লেখেন, ‘যেখানে এখনো ফুটপাত দখলমুক্ত এবং মশামুক্ত করা যায়নি, সেখানে স্মার্ট নগরী আকাশকুসুম চিন্তামাত্র…।’ মোরশেদ রানা নামের আরেকজন লেখেন, ‘যে মশা, এমনিই স্মার্ট হইয়া গেলাম কামড় খাইতে খাইতে।’ শাহ জাহান আকুতি জানিয়ে লেখেন, ‘মশা থেকে আমাদের বাঁচান।’ মোহাম্মদ জাবের মন্তব্য করেন, ‘মাননীয় মেয়র মহোদয়, আগে নগরবাসীকে মশার প্রকোপ থেকে বাঁচান।’
এর দুই দিন আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নিজ কার্যালয়ে নথিপত্র স্বাক্ষর ও যাচাই করছেন এ রকম চারটি ছবি ফেসবুক পাতায় দেন। ছবিগুলোর ক্যাপশন দেন ‘নগরবাসীর সেবায়…’। মেয়রের এই স্ট্যাটাসে ২৪ জন মন্তব্য করেন। তাঁর মধ্যে ১৩টিই ছিল মশা নিয়ে। শান্ত নামের একজনের আইডি থেকে মন্তব্য করা হয়, ‘মশার জন্য না পারতেছি ঘরে থাকতে, না পারতেছি বাহিরে হাঁটতে। খুবই ভালোই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।’ আহমেদ নামের আরেকজন লেখেন, ‘আপনার সেবায় নগরবাসী শিহরিত, মশার ভালোবাসায় বীর চট্টলার জনগণ সিক্ত, দয়া করে আর সেবা করিয়েন না।’
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কমিটির সভাপতি মো. মোবারক আলী প্রথম আলোকে বলেন, মশার ওষুধ যে একেবারে ছিটানো হচ্ছে না তা নয়। অবশ্য অ্যাডাল্টিসাইডের সংকট রয়েছে। তবে মশা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছেন। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ক্রয়প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রথম দফায় ওষুধ কেনার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এখন আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশাবিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, বছরের কোন সময় মশার উপদ্রব বাড়ে, তা আগে থেকেই জানা। তাহলে কেন আগে থেকে মশা নিধনের ওষুধ কেনার প্রস্তুতি নেওয়া হয় না? জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশা এবং জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিষয়টি যেহেতু আগে থেকে জানা আছে এবং ক্রয়প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, তাই মৌসুম শুরুর ছয় মাস আগে থেকে ওষুধ কেনার প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল সিটি করপোরেশনের।