লাল ফলে রাঙা হাসি ‘উদাল’গাছে

উদাল গাছে থোকা থোকা লাল ফল ঝুলে আছে। মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডে কোদালীছড়ার পাড়েছবি: প্রথম আলো

তখন ধীরে ধীরে রোদ বাড়ছে। সকালের হালকা রোদে জড়িয়ে আছে মিঠে ভাব। একটা কোমল শান্তি-প্রশান্তি আছে প্রকৃতিতে, শহরের এলোমেলো দালানকোঠার অলিতে-গলিতে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছে গাছে মৃদু হাওয়ার টোকা, পাতায় শান্ত কোলাহল ফুটছে।

এ রকম শান্ত সময়টিতে একটা জায়গায় চোখ আটকে যায়। সেই ‘তোমার অশোকে কিংশুকে/ অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে’...রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের ভেতর স্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠলেন, গুনগুনিয়ে উঠল কথামালা, সুর। জায়গাটিতে আরও কিছু গাছের ভেতরে একটি গাছে থোকা থোকা আগুনের মৃদু শিখা যেন থমকে আছে, দুলছে। গাছটির ডালে কোনো পাতা নেই। দূর থেকে দেখেও মনে হয় ‘চিনি উহারে’। দেখতে অশোক-কিংশুক মনে হলেও ওটা তা নয়, ওটা অন্য কিছু।

মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোড থেকে পশ্চিম দিকে একটু ভেতরে, কোদালীছড়ার উত্তর পাশে শরীরভরা থোকা থোকা লালে রঙিন হয়ে আছে গাছটি। দুই পাশে সবুজ আরও কিছু গাছপালা আছে। সেই সবুজের ভেতর গাছটি আলাদা। ওটা আসলে একটি ‘উদাল’গাছ। গাছটি অনেকের কাছেই অচেনা। শহর, গ্রাম কোনোখানেই খুব বেশি চোখে পড়ে না এখন উদাল। আর গাছের ডালে ডালে লাল রঙের যেটুকু উচ্ছ্বাস, তা এই গাছের ফুল নয়। এগুলো উদালগাছের ফল। ফুল অন্য রকম। ফুল কমলা-হলুদে মাখা, ঝুলন্ত মঞ্জরিতে গুচ্ছবদ্ধ থাকে। এখন ফুল নেই, ফুল ঝরে গেছে।

২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী উদাল প্রজাতি সংরক্ষিত।

ফুল যে ঝরে গেছে, তা দেখা গেছে শহরের আরও দু-একটি গাছে। তার একটি মৌলভীবাজার শহরের মুসলিম কোয়ার্টারে। একটি বাসার গাছে তখন লাল ফল ঝুলছিল। এক সকালবেলা গাছটিতে দেখা গেছে, অনেকগুলো কাঠশালিক ফলের ওপর এসে বসছে, এ–ডাল থেকে ও–ডালে উড়ে যাচ্ছে। দু-একটা বুলবুলিও ছিল। পাখিগুলো কোথা থেকে আসে, আবার হঠাৎ চলে যায়।

শহরের সৈয়ারপুর এলাকার মাঝেরহাটি সড়কে আরও একটি গাছে একইভাবে লাল ফল ঝুলে আছে। কিছু ফল তখনো কাঁচা, দেখতে অনেকটা বাঁকা লোমশ শক্ত শিমের মতো। হয়তো অনেকের চোখে পড়ে গাছগুলো, কেউ হয়তো মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে দেখেন। কারও হয়তো চোখ এড়িয়ে যায়। প্রকৃতি এ রকমই, তার আপন খেয়ালে আছে।

উদালের প্রিয় আবাসভূমি হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। সে কারণে উদালের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের খুব একটা চেনা জানা নেই
ছবি: প্রথম আলো

শীতের শেষে এই গাছগুলোতে কমলা-হলুদ রঙের ফুলের প্লাবন আসে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীত ফুরিয়ে গেলে ফুল ঝরে যায়। গাছে ফল আসে। এখন ডালে ডালে সেই লাল ফলেরই দেখা মিলছে। থোকা থোকা লাল ফল দেখতে অনেকটা পাপড়ি মেলা ফুলের মতো। কিছু ফল পরিপক্ব হয়ে গেছে। খয়েরি খোসা ফেটে কালো বীজ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে।

উদালের প্রিয় আবাসভূমি হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। সে কারণেই উদালের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের খুব একটা চেনা জানা নেই। উদালগাছ লম্বায় ২০ মিটার বা তার চেয়েও উঁচু হতে পারে। শীতে সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছ একদম উদোম হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতি সংরক্ষিত। উদালগাছের কাঠ বাদামি রঙের, কাঠ সাধারণত নরম ও হালকা। এই গাছের বাকল থেকে একধরনের আঁশ পাওয়া যায়, সে আঁশ দিয়ে মোটা রশি তৈরি করা হতো। বন উজাড়সহ নানা কারণে গাছটি আবাসস্থল হারিয়েছে। এখন মহাবিপন্নের দলে।