বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে প্রথমে দফায় দফায় মারধর করা হয়। এরপর খুঁটিতে বেঁধে ভিডিও ধারণ করে স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গুরুতর আহত ওই ব্যক্তি ওই অবস্থায় মারা যান। গতকাল শনিবার সকালে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের ছবিরপাইক গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম জহির উদ্দিন (৪০)। তিনি বিবিরহাটের সুন্দলপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর লামছি গ্রামের মো. মোস্তফার ছেলে।
এ ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও মুঠোফোনে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গতকাল গভীর রাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন হাবিব উল্যাহ (৪৫), আবদুর রব (৬৫) ও অজিউল্লাহ (৪০)।
এর আগে গতকাল রাতেই ঘটনার বিষয়ে জহিরের মা নাজিয়া খাতুন বাদী হয়ে কবিরহাট থানায় আটজনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। গ্রেপ্তার তিনজন ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
পুলিশ জানায়, মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ৩৩ জনকে। এর মধ্যে আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাকি ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আজ রোববার দুপুরে আদালতে পাঠানো হয়।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ছবিরপাইক গ্রামের একটি দোকানে চুরির অভিযোগে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী জহির উদ্দিনকে আটক করেন এলাকার কিছু লোক। তাঁরা তাঁকে ভোররাত সাড়ে চারটা থেকে সকাল পর্যন্ত দফায় দফায় পিটিয়ে নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। মারধরের পর গুরুতর আহত জহির উদ্দিনকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।
পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টার ভিডিও ধারণ করেন স্থানীয় কয়েকজন। এ রকম তিনটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায় অনেকের মুঠোফোনে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জহিরকে অন্ধকারের মধ্যে মাটিতে ফেলে মারধর করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে একজনকে জহিরের চোখ উপড়ে ফেলার কথা বলতেও শোনা যায়। মারধরকারীরা তাঁর চোখ, মুখ, হাত, পা–সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে খুঁচিয়ে জখম করে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করেন। ভোররাত থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত দফায় দফায় তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সে অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
কবিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহিন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা ছবিরপাইক এলাকায় এক ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার খবর পান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। পরে এ ঘটনায় রাতে নিহত ব্যক্তির মা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তার আগে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনকে আটক করে। যাঁদের পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জহির উদ্দিনকে মারধরের ঘটনা সকালেই থানা-পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় সকাল সাড়ে ১০টায়। ততক্ষণে পিটুনিতে আহত জহির উদ্দিন মারা যান। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তবে খবর পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছালে হয়তো জহিরকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো যেত।
নিহত জহিরের মা নাজিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। যারা চোর সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
সুন্দলপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, নিহত জহির উদ্দিন একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তিনি সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন। কিছুটা মানসিক সমস্যাও তাঁর রয়েছে। অনেক সময় মানুষের রান্নাঘরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। এ রকম একজন ব্যক্তিকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা ঠিক হয়নি বলেও উল্লেখ করেন এই ইউপি সদস্য। তিনি জানান, জহির উদ্দিন চার সন্তানের জনক ছিলেন।
কবিরহাট উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, নিহত জহির উদ্দিন ২০২০ সাল থেকে সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে আসছিলেন।