ডেলিভারিম্যান থেকে কুরিয়ারের মালিক

স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের কর্মীদের সঙ্গে এম রিদওয়ানুল বারী ও জোয়াইরিয়া মোস্তারি দম্পতি (মাঝে)
ছবি: সংগৃহীত

কলেজে পড়ার সময় প্রেম, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে গড়ায় পরিণয়ে। দুজনেই ছিলেন বেকার। ফলে পরিবার থেকে আসে বাধা। নিজেদের মতো করে স্বাবলম্বী হতে পারলে তবেই মেনে নেওয়া হবে এই সম্পর্ক—এমন শর্ত জুড়ে দেয় পরিবার। দিশাহারা এই তরুণ দম্পতি তাই নেমে পড়েন জীবনসংগ্রামে। শূন্য থেকে শুরু করা সেই যাত্রায় তাঁরা এগিয়েছেন বহুদূর। তাঁদের হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন প্রায় চার হাজার মানুষ।

ক্যারিয়ারে সফল এই দম্পতির নাম কে এম রিদওয়ানুল বারী (৩১) ও জোয়াইরিয়া মোস্তারি (৩১)। তাঁরা দুজনে মিলে গড়ে তুলেছেন স্টেডফাস্ট কুরিয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন রিদওয়ানুল আর জোয়াইরিয়া আছেন চেয়ারম্যান পদে।

রিদওয়ানুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্পটি জটিল। এইচএসসিতে রংপুরের বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছেন তাঁরা। সেখানেই তাঁদের প্রেম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাতপাঁচ না ভেবে পরিবারের অগোচরে দুজনে বিয়ে করে ফেলেন। বেকার অবস্থায় কী করবেন, কীভাবে চলবেন—এমন ভাবনায় অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। অন্যদিকে বিয়ের কথা পরিবারকে না জানানোর বিষয়টি নিয়েও ভাবনায় পড়েন।

রিদওয়ানুল জানান, ২০১১ সালে তিনি ঢাকায় গিয়ে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিষয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর স্ত্রী জোয়াইরিয়া ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাঁরা। দুশ্চিন্তায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। বাধ্য হয়েই নিজেদের পরিবারকে তাঁরা বিয়ের কথা জানান। উভয় পরিবার থেকেই আপত্তি আসে। অভিভাবকেরা শর্ত জুড়ে দেন, জীবনে ভালো কিছু করতে পারলে তবেই বিয়ে মেনে নেওয়া হবে। এমন কঠিন শর্তের মুখে তাঁরা বাড়ি ছাড়েন। পরিবার থেকে দেওয়া মাসের খরচও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শূন্য হাতে রিদওয়ানুল বারী তখন পড়াশোনার ফাঁকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। প্রশিক্ষণ নেন ওয়েব ডেভেলপিংয়ের। এরপর ২০১৪ সালে হাটবাজার ডটকম নামে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন। দমে না গিয়ে ২০১৬ সালে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় শুরু করেন কুরিয়ার সার্ভিসে ‘স্টেডফাস্ট’-এর ব্যবসা। তখন জনবল ছিল মাত্র চারজন। ঢাকা শহরে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের হয়ে ডেলিভারিম্যানের কাজও করেছেন। গ্রাহকদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিয়েছেন। এরপর সময়ের পালাবদলে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর।

বর্তমানে দেশের ৩০৩টি উপজেলায় এই কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় আছে। ঢাকায় আছে ২৬টি কার্যালয়। বর্তমানে কর্মরত জনবল ৩ হাজার ৯৯২ জন। এই দম্পতির বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায়। গঙ্গাচড়ার সহস্রাধিক মানুষকে তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন।

কর্মীদের সঙ্গে কে এম রিদওয়ানুল বারী (বাঁয়ে)
ছবি: সংগৃহীত

রিদওয়ানুল বারী বলেন, ‘বেকার অবস্থায় জীবনের প্রতিটি সময় কেটেছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। তবু থেমে যাইনি, ভয় পাইনি। বেকার অবস্থায় ভালোবেসে বিয়ে করার পর দিন কেটেছে খেয়ে না-খেয়ে। শূন্য হাতে ঢাকায় এসে আমার থাকার জায়গা ছিল না। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন কঠিন হয়ে উঠেছিল। কঠিন সংগ্রাম করে ঢাকা শহরে টিকে ছিলাম। আর আজ আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যেন ওই সমস্যায় না পড়েন, তাই কর্মীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। প্রতিষ্ঠানের খরচে প্রত্যেক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ঢাকার ৫০টি ফ্ল্যাটে আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। শুধু উচ্চশিক্ষিত নয়, স্বল্পশিক্ষিত মানুষও আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।’

অন্য কুরিয়ার সার্ভিসের মতোই সেবা দেওয়া হলেও কিছুটা ব্যতিক্রম আছে উল্লেখ করে রিদওয়ানুল বারী বলেন, স্টেডফাস্ট মানে অবিচল, নিরবচ্ছিন্ন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট কিংবা মালামাল হোম ডেলিভারি দেন। একইভাবে কুরিয়ারের অ্যাপ কিংবা পোর্টালে কেউ জানালে মালামাল কিংবা ডকুমেন্ট বাড়ি কিংবা যেকোনো স্থান থেকে নিয়ে আসেন। আছে অনলাইন ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ক্যাশ অন ডেলিভারি সুবিধা।

স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের নিয়মিত সেবা নেন রংপুর নগরের ডিমলা এলাকার ‘রকমারি শিশুঘর ডট কম’ নামে একটি অনলাইন ব্যবসার মালিক জিতু রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের পোশাক ও খেলনা নিজের কারখানায় তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করি। এই ব্যবসায় অনেকটা সহায়তা করছে স্টেডফাস্ট কুরিয়ার। অনলাইনে বুকিং দেওয়া পণ্য দ্রুত এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দেয় তারা।’

স্টেডফাস্ট কুরিয়ার লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি কুরিয়ার ও মেইলিং অপারেটর হিসেবে স্টেডফাস্ট কুরিয়ার সার্ভিসের নিবন্ধন রয়েছে বলে জানালেন এই উদ্যোক্তা।

নিজেদের বেকার জীবনের কষ্টের গল্পের কথা উল্লেখ করে জোয়াইরিয়া মোস্তারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদিনের জন্য অনেক কষ্ট ও চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। উভয় পরিবারে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা এখন ঈর্ষণীয়।’

গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেন, ‘রিদওয়ানুল আমাদের গর্ব। তিনি একজন উদ্যোক্তা। আমরা যা করতে পারিনি, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানে গঙ্গাচড়ার কয়েক শ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটা বিশাল ব্যাপার।’