কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইরের একটি প্রশিক্ষণে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।

  • ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এখন প্রায় ৬ লাখ ২১ হাজার।

  • অনলাইনে কৃষি কর্মকর্তা তালহা জরুরি কৃষিতথ্যের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন।

  • গত ৩ বছরে ৪০০ তরুণ-তরুণী মাঠে গিয়ে হাতে–কলমে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩১২ জনই খামার করে পেয়েছেন সাফল্য।

কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চান তাঁরা। এ জন্য ফসলের খেতে তালহা জুবাইর মাসরুরের কাছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন
ছবি: সংগৃহীত

কৃষি কেবল বংশপরম্পরায় কৃষকেরাই করবেন, এ গৎবাঁধা ধারণা ভেঙে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গার এক কৃষি কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি করেও এই কর্মকর্তা কেবল তাঁর দাপ্তরিক কাজের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের কৃষিদর্শন ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের। সঙ্গে ডিজিটাল কৃষি সম্প্রসারণ উদ্যোগ হিসেবে একটি ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন কৃষি উদ্যোক্তা হতে।

গত ৩ বছরে ৪০০ তরুণ-তরুণী মাঠে গিয়ে হাতে–কলমে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩১২ জনই নিজস্ব বাণিজ্যিক কৃষি খামার করেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন। এসব খামারে অন্তত ৩ হাজার ২০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

এই কর্মকর্তার নাম তালহা জুবাইর মাসরুর। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা থেকে সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত উপপরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘কৃষি বায়োস্কোপ’। যেখানে এ পর্যন্ত কৃষিবিষয়ক ৩১৬টি ভিডিও দিয়েছেন তিনি। এই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এখন প্রায় ৬ লাখ ২১ হাজার।

ফেসবুকে একই নামে তাঁর ভেরিফায়েড পেজের অনুসারী ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। ইউটিউব ও ফেসবুকে তাঁর কৃষিবিষয়ক ভিডিওগুলো দেখেছেন ২০ কোটিরও বেশি মানুষ। এতে কৃষিপ্রযুক্তি দ্রুত সম্প্রসারিত ও কৃষি অনুরাগীদের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে। এমনকি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইরের একটি প্রশিক্ষণে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।

সে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেছেন খুলনার ছেলে মো. তরিকুল ইসলাম। তাঁর ফল ভালো হওয়ায় হতে পারতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। কিন্তু তিনি হয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তা। কৃষিই এখন ধ্যানজ্ঞান ও আত্মতৃপ্তির জায়গা। ২০২১ সালে রোজার মাসে ‘গোল্ডেন ক্রাউন’ নামে সোনালি রং, চমৎকার আকার ও নতুন স্বাদের যে তরমুজের সঙ্গে খুলনাবাসীর পরিচয় ঘটেছিল, তা ছিল তরিকুলের খামারের। তাঁর খামারে চাকরি করছেন অনেকে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে কাজের ক্ষেত্র।

তরিকুল বলেন, ‘যেকোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক হিসেবে আমাকে নেয়নি। কৃষিবিদ তালহা জুবাইর মাসরুরের ইউটিউব চ্যানেল কৃষি বায়োস্কোপে ভিডিও দেখে কৃষিতে আগ্রহী হই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় প্রশিক্ষণের আয়োজন করলে প্রথম ব্যাচেই অংশ নিই। ছয় বিঘা জমিতে প্রকল্পের কাজ শুরু করি। বর্তমানে আমার ১৬ বিঘার প্রকল্পে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে।’

উজ্জ্বল হোসেন ও রবিউল ইসলাম দুই ভাই। বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার যদুপুর গ্রামে। মালয়েশিয়াফেরত উজ্জ্বল জানান, মালয়েশিয়ায় চাকরিকালীন নিয়মিত কৃষি বায়োস্কোপ দেখতেন। কৃষির দিনবদলের খবর আশা জাগাত মনে। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে কৃষিবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। উজ্জ্বল বলেন, ‘ওই প্রশিক্ষণের পর বিদেশে যাওয়ার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলি।

তালহা জুবাইরের পরামর্শে সদ্য বিএ পাস করা ছোট ভাই রবিউলকে নিয়ে শুরু করি ড্রাগনের চাষ। নিজের সঞ্চিত ও এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় প্রথমে পারিবারিক তিন বিঘা জমি দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ১৬ বিঘা জমিতে সম্প্রসারিত এই বাগান। চলতি মৌসুমেই ৫৭ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছি। এর আগের দুটি মৌসুমে যথাক্রমে ১৬ ও ২৭ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করা হয়। তিন বছরে ড্রাগন বিক্রি হয়েছে এক কোটি টাকার।’

ঝিনাইদহ সদরের বাজারগোপালপুরের আহসানুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর কৃষির সঙ্গে ছিলাম। তবে সেটি ছিল অপরিকল্পিত। তালহা জুবাইরের উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের সময় রিসোর্স পারসন এম এ রহিম ও মেহেদী মাসুদসহ দেশবরেণ্য কৃষিবিজ্ঞানীদের সাহসে উচ্চমূল্যের ফলে আবাদ করতে সাহস পাই। আগে ২৫ বিঘা জমিতে আম-লিচুসহ বিভিন্ন ফলের চাষ ছিল। বর্তমানে এলাকায় ৫৫ বিঘা জমিতে পরিকল্পিত উপায়ে ফল ও ফসলের আবাদ চলছে। এসব জমিতে ড্রাগন, অ্যাভোকাডো, ফিলিপাইনের কালো আখ, পেয়ারা, আম, লিচু, গম, শর্ষে ও ভুট্টার আবাদ চলছে। গত বছর প্রকল্প থেকে সব মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকা আয় হয়। আর এ বছর শুধু ড্রাগন থেকেই এসেছে ৫৫ লাখ টাকা। অন্যান্য ফসল ধরলে লাভ প্রায় ৭৫ লাখ টাকা হবে।’

‘কৃষি বায়োস্কোপ’ ইউটিউব চ্যানেলটি তালহা প্রতিষ্ঠা করেন ২০১৬ সালে। এই চ্যানেলে উচ্চমূল্য ফল-ফসলের আবাদ, প্রযুক্তি ব্যবহার ও সফলতার চিত্র তুলে ধরছেন তিনি। এই চ্যানেলে তালহার তৈরি করা ভিডিওগুলো ইউটিউব ও ফেসবুকের পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে বড় পর্দায় (প্রজেক্টর) ও কেবল টিভিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে তাঁর কাছে কৃষি–পরামর্শ নিচ্ছেন অনেকে।

তাঁর করা মেটে আলুর (গাছ আলু) চাষবিষয়ক একটি ভিডিও গত ৬ মাসে দেখেছেন প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এ ছাড়া ড্রাগন চাষের আধুনিক পদ্ধতি (আলট্রা হাইডেনসিটি), বারোমাসি কাটিমন আম, বারি মাল্টা-১, বারোমাসি সিডলেস লেবু, বলসুন্দরি কুল চাষ–পদ্ধতির ভিডিও দেখে ২ হাজারেরও বেশি মিশ্র ফলের বাগান হয়েছে দেশে।

কৃষি বায়োস্কোপের ভেরিফায়েড পেজের নিজস্ব কল সেন্টার রয়েছে, যার মাধ্যমে বিনা মূল্যে কৃষিবিষয়ক সেবা দেওয়া হচ্ছে। ভিডিওগুলো সারা দেশে কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পেয়েছেন স্বীকৃতিও

ডিজিটাল কৃষি সম্প্রসারণে অবদান রাখায় তালহা জুবাইর মাসরুর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার (স্বর্ণপদক) পান। এর আগে পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ভিএসও-প্রথম আলো স্বেচ্ছাসেবা (কৃষি) সম্মাননা-২০১৯।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই আয়োজিত উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে ২০১৭ সালে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা মনোনীত হয়েছেন। ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার মূলনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন যুক্তরাজ্যের কর্নেল অ্যালায়েন্স ফর সায়েন্স পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুরো বিশ্ব থেকে এমন পাঁচজন তরুণ ব্যক্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাঁরা নিজেদের নিরলস চেষ্টায় বৈশ্বিক কৃষিতে পরিবর্তন আনছেন। এর মধ্যে তালহা একজন।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইরকে আমন্ত্রণ জানান ছয় মাসের একটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্নেল অ্যালায়েন্স ফর সায়েন্স কমিউনিকেশন তালহার দেখানো কৃষিপদ্ধতি আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে কাজে লাগানোর কাজ শুরু করেছেন।

তালহা জুবাইর প্রথম আলোকে বলেন, কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং তরুণদের উজ্জীবিত করতেই তিনি প্রশিক্ষণের আয়োজন করছেন। কৃষি ও কৃষককে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেটিই তাঁর লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শুধু পাস করেই চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরা উদ্যোক্তা হতে হবে এবং অন্যকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তিনি এ কথাই অনুসরণ করে যাচ্ছেন।