এডিপির প্রকল্পে নয়ছয়, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার হোসেনপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে নির্মিত ছাউনিছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় এডিপির প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে প্রকল্প কমিটি যেসব কাজ করেছে, সেসব কাজে অনিয়ম বেশি হয়েছে।

এসব প্রকল্পের মধ্যে কোনোটির অর্ধেক, আবার কোনোটির কাজ না করেই টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামেও টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী ও প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যানরা প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্র জানায়, সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফুলছড়ি উপজেলা। গত ২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩ তিনটি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় উপজেলার রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৮ হাজার টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯টি প্রকল্পের ১ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ হাজার টাকার কাজ দরপত্রের মাধ্যমে, ৬টি প্রকল্পের ২৫ লাখ ৮ হাজার টাকার কোটেশনের মাধ্যমে এবং ৭৭টি প্রকল্পের ২ কোটি ১৮ লাখ ১৭ হাজার টাকার কাজ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে করা হয়।

সম্প্রতি অন্তত পিআইসির ১০টি প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ কাজেই নয়ছয় হয়েছে। কোনোটির কাজ অর্ধেক হয়েছে। কোনোটির কাজ না করেই টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এমনকি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামেও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গণপাঠাগার উন্নয়ন প্রকল্পে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে এই নামের পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। চৌধুরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের গ্রামে এই নামের কোনো পাঠাগার আছে বলে জানা নেই। এর কোনো কার্যালয় ও কার্যক্রমও চোখে পড়েনি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই গ্রামের এক ব্যবসায়ী জানান, গণপাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ভুয়া ভাউচারে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই বিষয়ে চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুল মালেক বলেন, বর্তমানে এই গণপাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। জানতে চাইলে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হাবিবুর রহমান দাবি করেন, গণপাঠাগারটি এখন নেই। তবে ওই সময় গণপাঠাগারের কার্যক্রম ছিল।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের উড়িয়া হাওয়া ভবন একতা যুব সংঘের ঘর নির্মাণে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সামান্য কিছু টাকার কাজ করেই বিল তুলে নেন প্রকল্প কমিটির সদস্যরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উড়িয়া গ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, সামান্য কয়েকটি আসবাব কিনে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে প্রকল্প কমিটির সদস্য ও একতা যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন দাবি করে বলেন, উপজেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে উড়িয়া হাওয়া ভবন একতা যুব সংঘের ঘর নির্মাণ ও আসবাব কেনা হয়েছে। বরাদ্দ টাকা দিয়ে শতভাগ কাজ হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বোচারবাজার, হোসেনপুর ও কাঠুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে ছাউনি নির্মাণ প্রকল্পে ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্লিনিকের সামনে সামান্য কিছু টাকা ব্যয় করে কোনোমতে একচালা ছোট্ট আকারে ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে ছাউনির চারপাশে বেড়া দেওয়া হয়নি। হোসেনপুর গ্রামের সংস্কৃতিকর্মী ওমর ফারুক বলেন, ‘আমার বাড়ির কাছেই এসব ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ছাউনি নির্মাণে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। তিনটি ছাউনি মিলে মোট ব্যয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি হবে না। অথচ যেনতেন কাজ করে বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।’

জানতে চাইলে ছাউনি নির্মাণ প্রকল্প কমিটির সভাপতি উদাখালী ইউপির সদস্য (১ নম্বর ওয়ার্ড) মকবুল হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ‘এই তিনটি ছাউনি নির্মাণে আমাকে শুধু প্রকল্প সভাপতি করে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। আমি কোনো ছাউনি নির্মাণ করিনি। উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ তাদের লোক দিয়ে এসব ছাউনি নির্মাণ করে নেয়। সেখানে অনিয়ম হয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।’

সরেজমিনে দেখা প্রকল্পের মধ্যে বাকি সাতটি প্রকল্প হচ্ছে চন্দিয়া বানিয়াপাড়া মিল্লাতের বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে প্যালাসাইটিং নির্মাণ, কঞ্চিপাড়া রেলগেট বাজারের সামনে রাস্তার ঢালের আরসিসি ঢালাই, কেতকিরহাট মাদ্রাসা, সমিতির বাজার মহিলা মাদ্রাসা ও পূর্ব মদনের পাড়া মক্তবঘর নির্মাণ, এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের আনন্দবাড়ি নুরানি মাদ্রাসা ও ভাটিয়াপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা সংস্কার, গজারিয়া ইউনিয়নের সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পেছন থেকে সামাদ মিয়ার বাড়ি অভিমুখে পানিনিষ্কাশনের নালা নির্মাণ, চরহরিচণ্ডী চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের রাস্তা প্যালাসাইডিং নির্মাণ এবং ফুলছড়ি ইউনিয়নের শাপলা বাজারের শৌচাগার ও প্রস্রাবখানা নির্মাণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অভিযোগ করেন, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি যোগসাজশে এসব প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এসব বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এডিপির এসব কাজ বাস্তবায়নের সময় আমি এখানে দায়িত্বে ছিলাম না। আমার পূর্ববর্তী উপজেলা প্রকৌশলীদের সময়ে এসব কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁরা এখন বদলি হয়ে কোথায় গেছেন, তা-ও আমি জানি না। তবে ওই সব কাজের বিপরীতে যে জামানত থাকে, তা আমি এসে পাইনি।’

বর্তমান ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের আগে সাত-আটমাস উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন ফিরোজ রহমান। তিনি বর্তমানে কুড়িগ্রামের চিলমারি উপজেলায় কর্মরত আছেন। গত রোববার এডিপির প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফিরোজ রহমানের আগে প্রায় দুইবছর ফুলছড়িতে দায়িত্বে ছিলেন ইমতিয়াজ আহম্মেদ। তিনি বর্তমানে এলজিইডি ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। তাঁর মুঠোফোনের নম্বর না পাওয়ায় এই অভিযোগের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এই বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, এডিপির কিছু কিছু প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে ঠিক। তবে এগুলো দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের। তিনি আরও বলেন, ‘কাজ সম্পন্ন করার পর প্রকৌশল বিভাগ আমার কাছে বিল দাখিল করে। আমি তাতে শুধু সই দিয়েছি।’