নীলফামারীতে প্রথমবারের মতো এবার গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের সহায়তায় চাষ করে প্রথমবারেই সাফল্য পেয়েছেন কৃষকেরা। এতে অনেক কৃষকই তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র অনুযায়ী নীলফামারী জেলা শীতপ্রধান হওয়ায় জেলার কোথাও স্বাভাবিক সময়ে তরমুজ চাষ করেন না কৃষক। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে এ অঞ্চলের আবহাওয়া এবং মাটি উপযোগী।
দেশের অন্যান্য জেলায় স্বাভাবিকভাবে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম পর্যন্ত তরমুজের বীজ রোপণ করা হয়। কিন্তু নীলফামারীতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে তরমুজের বীজ রোপণ করা হয়। কৃষি বিভাগের অনুপ্রেরণায় এবার জেলা সদরের তিনজন কৃষক ৩৪ শতাংশ জমিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছেন।
গত রোববার জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের কানিয়ালখাতা ও পৌরসভা এলাকার হাড়োয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাচায় ঝুলছে হলুদ ও সবুজ রঙের গ্রীষ্মকালীন তরমুজ।
জেলায় প্রথমবারের মতো তরমুজ চাষ করা তিন কৃষকের মধ্যে অন্যতম কানিয়ালখাতা গ্রামের তরমুজচাষি সামছুল হক (৩৫)। তরমুজ চাষের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিবছর বেগুন, পটোল, ঢ্যাঁড়সসহ অন্যান্য শাকসবজির আবাদ করি। এই বছর প্রথম ১৫ শতাংশ জমিতে তরমুজের আবাদ করেছি। ফলন খুব ভালো হয়েছে।
আমার খেতের তরমুজ দেখার জন্য দূরদূরান্তের মানুষ প্রতিদিন আসেন। আমার দেখাদেখি আশপাশের মানুষ তরমুজ আবাদ করতে চান। তরমুজগুলো আরেক সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি করা যাবে। তরমুজগুলোর রং ও স্বাদ ভালো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহযোগিতায় ১৫ শতাংশ জমিতে তিনি তরমুজ চাষ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
একই গ্রামের কৃষক মো. ছকিমুদ্দিন (৬০) বলেন, ‘হামরা তো বেগুন, পটোল, কুমড়া, ধান, পাট সবে আবাদ করি। কিন্তু এইবার সামছুল হক তরমুজ চাষ করি হামাক তাক নাগে দিছে। মিষ্টিকুমড়া, পটোল, বেগুন এইলার দাম কম। তরমুজের দাম সব সময় বেশি। এত দিন জানছি, হামার এত্তি তরমুজ আবাদ হয় না। এখন থাকি হামরাও তরমুজ আবাদ করমো। তাতে লাভ বেশি হইবে।’
‘গ্রীষ্মকালীন তরমুজ উচ্চ মূল্যের ফসল। এ অঞ্চলে বেলে দো-আঁশ মাটি তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। আমরা প্রথমবারের মতো এর চাষ করে সফলতা দেখছি।’মো. আতিক আহমেদ, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
কৃষক আবদুল ওহাব (৫৫) বলেন, ‘তরমুজ হামার এলাকাত নয়া ফসল। এই মাটিত তরমুজ আবাদের কথা আগত হামরা চিন্তাও করি নাই। সামছুলের তরমুজ বাগান দেখির জন্য বাইরের মানুষ আইসেছে। আবাদের নিয়মকানুন জানি নেয়ছে। পরিশ্রম করির পাইরলে নয়া ফসল হিসাবে তরমুজ আবাদ করি লাভ করা যাইবে।’
পৌরসভার হাড়োয়া জাফরাবাদ মহল্লার নুরীন নূর ওরফে মুক্তা (৩০) বলেন, ‘আমি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরামর্শে ১০ শতাংশ জমিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছি। শখের বশে এটির চাষ করলেও এর ফলন ও স্বাদ দেখে মনে হচ্ছে আরও বেশি জমিতে করা প্রয়োজন ছিল। তবে এ বছর যা-ই হোক, ভবিষ্যতে আমি বেশি জমিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করব।’
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এস এম রাকিব আবেদীন বলেন, ‘আমাদের তিনটি ব্লকে ৩ জন কৃষক ৩৪ শতাংশ জমিতে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক তরমুজ চাষ করেছেন। এখানে দুটি জাতের তরমুজ রয়েছে। একটি তৃপ্তি, অপরটি ব্ল্যাকবেবি। দুটিরই ভেতরের অংশ লাল হবে।
প্রতিটি ব্লকে ফলন ভালো হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ওই সব তরমুজ বাজারজাত করা যাবে। বর্তমানে বাজারে ওই তরমুজ সর্বনিম্ন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে এক বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি করা যাবে দুই লাখ টাকার ওপরে। কৃষকদের তরমুজবাগান দেখে আশপাশের কৃষকেরাও তরমুজ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আশা করছি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ব্যাপক হারে গ্রীষ্মকালীন তরমুজের চাষ বাড়বে।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রীষ্মকালীন তরমুজ উচ্চ মূল্যের ফসল। এ অঞ্চলে বেলে দো-আঁশ মাটি তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। আমরা প্রথমবারের মতো এর চাষ করে সফলতা দেখছি।’
আতিক আহমেদ বলেন, ‘তরমুজের মূল সমস্যা শীত। এ অঞ্চলে শীত বেশি হওয়ার কারণে স্বাভাবিক সময়ের তরমুজ এ অঞ্চলে হয় না। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে লাভ বেশি। বীজ রোপণের ৮০ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা যায়। জৈব বালাইনাশক ও জৈব সার দিয়ে এর চাষ করা হচ্ছে। এটি যেমনে রসাল, তেমনি সুমিষ্ট।’