কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হাজেরা বললেন, ‘এমন দিন আমার সন্তানদের যেন না আসে’

ঈদের দিনে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকেন স্বজনদের। গতকাল দুপুরে গাজীপুর সদর উপজেলার বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

‘ঈদের সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সন্তানকে গোসল করাতাম। নতুন জামাকাপড় পরিয়ে চুল আঁচড়ে বারবার দেখতাম কেমন লাগে। সেমাই ও পিঠা মুখে তুলে দিয়ে পরম যত্নে খাওয়াতাম। পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে নামাজে পাঠাতাম তাকে। আজকে আমার সেই সন্তানকে মনে পড়ছে, যার সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না।’

কথাগুলো বলতে বলতে আঁচলে নিজের কান্না লুকাতে চেষ্টা করছিলেন হাজেরা খাতুন। তিনি থাকেন গাজীপুর সদর উপজেলার বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে (বৃদ্ধাশ্রম)। সন্তানের স্মৃতি মনে করে শেষ পর্যন্ত চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না হাজেরা খাতুন। কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার পেট তো বড়। আমাকে লালনপালন করলে সন্তানের লস। এই যে আমি ঈদের দিন একা একা খাই, নিঃসঙ্গ বসে থাকি—এমন দিন আমার সন্তানদের যেন কখনো না আসে। আমি চাই না আমার সন্তান আমাকে ভেবে কষ্ট পেয়ে কান্না করুক।’

গতকাল শনিবার ঈদুল ফিতরের দিন দুপুরে বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে গিয়ে হাজেরা খাতুনের মতো অনেকের জীবনের মর্মস্পর্শী গল্প জানা গেল। পরিবার নিয়ে কারও কণ্ঠে শোনা গেল অভিমানের সুর। কেউ প্রকাশ করলেন ক্ষোভ। কেউ আবার বুকের ভেতর চাপিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসকে আড়ালের চেষ্টা করলেন হাসিতে।

সবুজ গাছপালায় সমৃদ্ধ শান্ত সুনিবিড় বৃদ্ধাশ্রম
ছবি: প্রথম আলো

খতিব আবদুল জাহিদের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গতকাল বৃদ্ধাশ্রমটিতে গিয়ে দেখা গেল, কেন্দ্রটির এক প্রান্তে বিশাল টানা বারান্দা। বারান্দা-লাগোয়া কক্ষে থাকেন নিঃসঙ্গ নারীরা। প্রতিটি কক্ষের সামনে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চে বসে আছেন নিঃসঙ্গ মায়েরা। বৃদ্ধাশ্রমের অন্য পাশে বহুতল ভবনে পুরুষদের থাকার জায়গা। সবুজ গাছপালায় সমৃদ্ধ শান্ত সুনিবিড় বৃদ্ধাশ্রমের পথে হাঁটছিলেন কয়েকজন।

মধুর স্মৃতি হাতড়ে যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করছেন চার ছেলে ও এক মেয়ের মা আয়েশা খাতুন (৮০)। তিনি বলেন, ছেলেদের স্ত্রীরা তাঁর দায়িত্ব নিতে চান না। তাই এক স্বজনের সহায়তায় বৃদ্ধাশ্রমে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর তাঁর এক ছেলে মাঝেমধ্যে খোঁজখবর রাখেন। কিন্তু পরিবারে ফিরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা।

আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে চান না আছিয়া বেগম। গতকাল গাজীপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

‘ঈদের দিন ভাবছিলাম আমার ছেলে আইবো। কিন্তু আহে নাই। একটাই ছেলে আমার। আমি আর কারও অপেক্ষা করুম না।’ বলছিলেন আছিয়া বেগম (৮৫)। বৃদ্ধাশ্রমে আছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে। ঈদে সব থাকলেও স্বজনদের কাছে না থাকা উৎসব আনন্দময় হয় না বলে কণ্ঠে আক্ষেপ ছিল তাঁর।

বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রের হোস্টেল সুপারভাইজার হাবিবা খন্দকার জানান, বৃদ্ধাশ্রমের প্রত্যেক নারী-পুরুষের চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নিয়োজিত। বয়স ও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় তাঁদের উপযোগী উন্নত খাবার সরবরাহ করা হয়।

পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা একদমই বলতে চান না এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ। তিনি তাঁর পরিচয়ও দিতে চাননি। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের হিসাবরক্ষণ বিভাগের চাকরি করতেন। শুধু বললেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে খুব ভালোভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করেছি। আমার একটা কষ্ট আছে, সেই কষ্টেই ঘর ছেড়েছি। কে না চায় ঘরে ফিরতে। আমি ঘরে ফিরতে পারব না, সীমাবদ্ধতা আছে।’

বৃদ্ধাশ্রমের এক পাশে বহুতল ভবনে পুরুষদের থাকার জায়গা
ছবি: প্রথম আলো

নিজের কক্ষের জানালার গ্রিল ধরে আনমনে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন নূর মোহাম্মদ (৭৫)। তাঁর দুই ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেদের একজন গাড়ি চালান। ছেলে ও ছেলের স্ত্রী তাঁর দেখভাল করতে রাজি নন। তাই দুর্দশার কথা ভেবে জামাতা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে যান তাঁকে। নূর মোহাম্মদ কণ্ঠে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমার তো বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে। ভীষণ ইচ্ছা করে নিজের মাটি ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হয় না। আপনজনদের ছেড়ে ঈদ কতটুকু আর আনন্দময় হতে পারে?’

বাগেরহাট সদর উপজেলার গোটাপাড়া গ্রামের আবুল বাসারের (৭৬) দুই সন্তান। মেয়ে ঢাকায় থাকে। ছেলে কুয়েতপ্রবাসী। ঈদ কেমন কাটালেন—এমন প্রশ্নে আবুল বাসার চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন, ‘খুব ভালো ঈদ করেছি। বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো কেন—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘বাড়িতে ভালো লাগে না তাই।’

ঈদের দিনে বৃদ্ধাশ্রমের খাবারে ছিল বিশেষ আয়োজন
ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ আয়োজন ছিল বলে প্রথম আলোকে জানান বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর মো. রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ভেতরেই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে সবার জন্য ছিল সেমাই ও মুড়ি। নামাজের পর দেওয়া হয়েছে খিচুড়ি। এরপর দুপুরে ছিল বিভিন্ন ধরনের মাংস দিয়ে পোলাও ও ভাত। ঈদের দিন পুনর্বাসনকেন্দ্রে থাকা বৃদ্ধদের সঙ্গে অনেকের স্বজনেরা দেখা করতে আসেন।