লাউয়াছড়া, সাতছড়ি ও বর্ষিজোড়াকে বন্য প্রাণীর ‘উত্তম আবাসস্থল’ বানাতে নতুন প্রকল্প

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

লাউয়াছড়া, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকোপার্ককে বন্য প্রাণীর ‘উত্তম আবাসস্থল’–এ পরিণত করাসহ বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বন বিভাগ। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে বনায়ন ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন’।

গত মে মাসে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় এ প্রকল্প পরিকল্পনা গত মে মাসে বন অধিদপ্তরে জমা দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।

প্রকল্পে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজারের ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও সংলগ্ন সংরক্ষিত বনটি জীববৈচিত্র্য ও মূল্যবান বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অসংখ্য প্রজাতির জীবজন্তুর আবাসস্থল। এই বনে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ১৬৭ প্রজাতির প্রজাপতি ও অসংখ্য কীটপতঙ্গ আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ, বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণে প্রতিবছর হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক লাউয়াছড়ায় আসেন।

অন্যদিকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলার মধ্যে পড়েছে রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ। পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ, আঁকাবাঁকা সাতটি ছড়া (খাল), উঁচু-নিচু পাহাড়বেষ্টিত উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বনাঞ্চলটি। এই বনের ২৪৩ হেক্টর বনভূমিতে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। আয়তনে কম মনে হলেও দেশের অন্যান্য প্রাকৃতিক বনের তুলনায় উদ্যানটি উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সাতছড়ি প্রায় ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১৯০ প্রজাতির প্রজাপতির আবাসস্থল।

এ ছাড়া মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় অবস্থিত বর্ষিজোড়া ইকোপার্কটির আয়তন ৩৯৫ হেক্টর। এই বনে শাল, গর্জন, কড়ই, ডুমুর, রক্তন, মেন্দা, তেলসুর, চাপালিশ, ডেওয়া, সেগুন, আমলকী, জলপাই, আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, রাতা, বহেড়া, বাঁশ, কদম, লোহাকাঠ এবং অন্যান্য প্রজাতির লতা ও গুল্ম আছে। আছে বানর, লজ্জাবতী বানর, শিয়াল, হরিণ, মায়া হরিণ, কাঠবিড়ালি, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, শজারু, সিভেট, বনবিড়াল, বেজি, অজগর, গোখরা, পিট ভাইপার, মনিটর লিজার্ড, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি। ৭০ প্রজাতির পাখির মধ্যে আছে পাহাড়ি ময়না, ধনেশ, মথুরা, বনমোরগ, ব্যাবলার, লাফিং থ্রাস, বারবেট, প্যাঁচা, সবুজ ঘুঘু ইত্যাদি।

প্রকল্প পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, স্থানীয় জনগণ জীবন-জীবিকার জন্য এই বনগুলোর ওপর নির্ভর করে। এতে বনাঞ্চল ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু ও সংকুচিত হয়ে পড়ে। অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি বিরল ও বিপন্ন হিসেবে টিকে আছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যমান বন্য প্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এই বনভূমিগুলোতে আনুভূমিক ও খাড়াভাবে বনের আচ্ছাদন বাড়ানো প্রয়োজন। বনাঞ্চলগুলোকে বন্য প্রাণীর উত্তম আবাসস্থলে পরিণত করতে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করা, বেতবাগান তৈরি, সহযোগী প্রাকৃতিক উদ্ভিদ পুনরুৎপাদনের পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

প্রকল্পটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস ও অভিযোজন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক অভিঘাত মোকাবিলায় ব্যাপক হারে বনায়ন ও পরিবেশবান্ধব আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যটনের জন্য পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ, গাছপালার সঙ্গে পরিচয়ের ব্যবস্থা, পর্যটকদের বসার বেঞ্চ, গোলঘর, ওয়াচ টাওয়ার, ওয়াশরুম, ফুট ট্রেইল, লেকের ওপর ঝুলন্ত সেতু, পাকা সিঁড়ি, ট্যুরিস্ট শেড, গাড়ি পার্কিং এলাকা, পর্যটক চলাচলে রাস্তার ওপর সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণ। এ ছাড়া বন্য প্রাণীর মৃত্যুরোধে উদ্যান এলাকার সড়কে গাড়ির গতিসীমা ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, স্পিড ট্র্যাকার স্থাপন, সড়ক ও রেললাইনের ওপর বন্য প্রাণী (উল্লুক, হনুমান ইত্যাদি) চলাচলে কেনোপিওয়ে নির্মাণ, বাটারফ্লাই পার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, উদ্যানের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, বন্য প্রাণীর জন্য জলাধার নির্মাণ, প্রাকৃতিক লেক, ছড়ার পুনঃখনন ও উন্নয়ন করার কথা বলা আছে প্রকল্পে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন বনায়ন, বৃক্ষে আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি। বন সংরক্ষণের মাধ্যমে বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা, বন্য প্রাণীসহ স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে চিত্তবিনোদনের জন্য পরিবেশবান্ধব সুযোগ সৃষ্টি। পর্যটন ও বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বন ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আগ্রহী গবেষকদের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আরও বলেন, তিনটি সংরক্ষিত বনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্য প্রাণী বনের কোর এলাকায় নির্বিঘ্নে থাকতে পারবে। সেখানে মানুষ যাবে না। লাউয়াছড়ায় বাঘমারা এলাকার উন্নয়ন করে পর্যটকের সুবিধা বাড়ানো হবে। সাতছড়ি ব্রিজের কাছে উন্নয়ন করা হবে। বর্ষিজোড়া মৌলভীবাজার শহরের কাছে, সেটির উন্নয়ন হলে মানুষ সহজেই সেখানে যেতে পারবে। এতে লাউয়াছড়ার ওপরও চাপ কমবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা হচ্ছে বন্য প্রাণী, উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেও মানুষের বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। প্রকল্পটি অধিদপ্তরে প্রক্রিয়াধীন।’