একযোগে আক্রমণের মুখে পালাল পাকিস্তানি সেনারা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই মুক্ত হয়েছিল কিছু অঞ্চল। কেমন ছিল সেসব অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষের আবেগ-অনুভূতি। সেই সময়ের চিত্র।

একাত্তরের শহীদদের স্মরণে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চণ্ডীদাসগাঁতি গ্রামে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভছবি : প্রথম আলো

একাত্তরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিরাজগঞ্জের কিছু এলাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী তখন সিরাজগঞ্জ শহরে অবস্থান নিলে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের চারপাশ থেকে একযোগে তাদের ওপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ৯ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানি বাহিনী পালাতে বাধ্য হয়। ১৪ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন।

কথাপ্রকাশ প্রকাশিত একাত্তরের গণহত্যা যমুনার পূর্ব–পশ্চিম বইয়ে শফিউদ্দিন তালুকদার লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকে। এই খবরে অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০ জনকে ধরে আনা হয়। তাদের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

সাইফুল ইসলামের অনুলিখনে মামুন রশীদ ও মনিরুজ্জামানের সম্পাদনায় বেহুলা বাংলা প্রকাশনী প্রকাশিত ১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি বইয়ে লেখা আছে, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভাঙতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কতগুলো যুদ্ধ হয়। ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে অনেকটা ঘিরে ফেলেন। স্থল ও নৌপথ মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য তখন একমাত্র রেলপথ খোলা ছিল।

ওই দিনের যুদ্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (ষষ্ঠ খণ্ড) বইয়ে বিস্তারিত লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পতন নিশ্চিত জেনে ১৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহর ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করে। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পেরেছিলেন যে এটাই তাঁদের শেষ সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার মুক্তিযোদ্ধারা করেছিলেন। পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি ও গোলাবারুদের যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম হন মুক্তিযোদ্ধারা।

বইয়ে বলা হয়েছে, ১৩ ডিসেম্বর সকালে খোকশাবাড়ি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে স্থানীয় লোকজন এসে খবর দেন যে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ শহর থেকে রেলপথে কামারখন্দ রওনা হয়। পথে কালিয়া হরিপুরের রেলওয়ে কালভার্ট ভাঙা থাকার কারণে তারা সেখানে নামে। তিনটি গাড়ি নিয়ে কামারখন্দ যাওয়ার জন্য রওনা হয়। কিন্তু সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া খায়। আবার শহরের দিকে ফিরতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী।

একই বইয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে মুক্তিযোদ্ধারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই দিকে রওনা হন। এক দলকে কালিয়া হরিপুর রেলস্টেশনে পাঠানো হয়, তারা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করেন। অন্য দলটি কালিয়া হরিপুরের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহরের ওপর আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি গাড়ির দুটি অকেজো করে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি বইয়ে ১৪ ডিসেম্বর দিনটি নিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ১৪ ডিসেম্বর পুরোপুরি নিশ্চিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে সমবেত হন। তাঁদের সঙ্গে উল্লাস করতে করতে যোগ দেন মুক্তিকামী জনতা। সবাই মিলে দেশগঠনের শপথ নেন।

মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার ওয়াপদা কার্যালয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মূল ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নেন। কওমী জুট মিল, মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিজয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।