হেঁটে হেঁটে বই বিলি

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে সুনীল কুমার গাঙ্গুলীছবি: নুতন শেখ

পরনে পুরোনো জ্যাকেট-প্যান্ট, পায়ে রবারের জুতা, গলায় প্যাঁচানো মাফলার, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে বেতের লাঠি। আঁকাবাঁকা, ভাঙাচোরা রাস্তায় লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে চলেছেন এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। ঝোলাভর্তি বই, সবই নিজের। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই বই বিলি করছেন। কোনো বাড়ি থেকে আগে দেওয়া বই ফেরত আনছেন। ৭৫ বছর বয়সেও রোজ নিয়ম করে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাজির হন তিনি। তাঁর চাওয়া একটাই, লোকে যেন একটু জানে, বোঝে, জ্ঞানলাভ করে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের এই জমানায় মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকে বেশি। কাগজের বইয়ের বদলে অনেকে ই–বুকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই সময়ে প্রবীণ একজন মানুষ ১০ বছর ধরে বাড়ি বাড়ি বই বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ যেন রাজশাহীর আরেক পলান সরকার, আরেক ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। তাঁর নাম সুনীল কুমার গাঙ্গুলী; বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের কুমরিয়া গ্রামে।

চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্রামে গ্রামে ঘুরে বই বিলি করে বেড়ান সুনীল গাঙ্গুলী
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিদিন প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে ঘুরে বই পৌঁছে দেন পাঠকের হাতে। এলাকার বিভিন্ন বয়সী লোকজনকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। পাঠক টানতে তাঁর আছে নানা কৌশল। বয়োজ্যেষ্ঠদের দেন ধর্মের বই, ছাত্রছাত্রীদের দেন বিভিন্ন মনীষীর জীবনী আর ছোটদের দেন গল্পের বই। সুনীল গাঙ্গুলীর নিজের একটি পাঠাগারও আছে। সেখানকার বইয়ের তালিকা পাঠকের হাতে তুলে দেন। পাঠক সেই তালিকা থেকে যে বই পছন্দ করেন, সেটিই তিনি পৌঁছে দেন তাঁর বাড়ি। পড়া শেষ হলে আবার ফেরত নিয়ে আসেন।

সুনীল গাঙ্গুলীকে ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’ উল্লেখ করে কুমরিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী বলেন, আশপাশের সাত গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নিতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

নিঃস্বার্থভাবে মানুষের মধ্যে বই বিলি করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন রাজশাহীর পলান সরকার। তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে ২০০৭ সালে প্রথম আলোতে ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র হয়। বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ২০১১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। ৯৮ বছর বয়সে ২০১৯ সালে মারা যান পলান সরকার।

ছোটকাল থেকেই বইয়ে আগ্রহ

সুনীল গাঙ্গুলী ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ২০১৫ সালে অবসরে যান। আগের বছর ২০১৪ সালে নিজ বাড়ির পাশে গড়ে তোলেন চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগার (পুত্রবধূর নামে)। তাঁর এই পাঠাগারে ছয় শতাধিক বই আছে। আগে থেকেই বই সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতেন তিনি।

কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের কালীগঞ্জ বাজার থেকে একটু পশ্চিমে যেতেই বাঁ দিকে ইটের সড়ক। সড়কটির কোথাও ইট আছে, কোথাও নেই; কোনো যানবাহন চলাচল করে না এই সড়কে। ইট বিছানো পথ ধরে প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে গেলে তবেই কুমরিয়া গ্রাম। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই গ্রামে প্রায় আড়াই হাজার লোকের বাস। গ্রামের দক্ষিণ কোণে সুনীল গাঙ্গুলীর টিনের বাড়ি।

কোনরকম স্বার্থ ছাড়াই মানুষের বাড়ি বাড়ি বই বিলি করেন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে গিয়ে তাঁকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আলাদা একটা আগ্রহ ছিল তাঁর। কিন্তু বই কেনার সামর্থ্য ছিল না। প্রতিবেশী এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করে পড়তেন। কিন্তু সেসব বই তাঁর মনের খোরাক মেটাতে পারত না। তখনই ঠিক করেছিলেন, সামর্থ্য হলে অনেক বই কিনবেন। নিজে পড়বেন, অন্যকেও পড়তে দেবেন। সেই সামর্থ্য অবশেষে সুনীল গাঙ্গুলীর হলো, তা–ও চাকরি থেকে অবসরের পরে। অবসর ভাতার টাকায় পাঠাগারের জন্য বই কিনলেন। সেসব বই–ই লোকজনকে পড়তে দেন।  

সুনীল গাঙ্গুলী বলেন, ‘শহরে যারা বাস করে, তারা সচেতন। আর গ্রামের মানুষ অনেক পিছিয়ে। আমাদের এই অজপাড়াগাঁয়ে এখনো অনেক কুসংস্কার রয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এই দারিদ্র্য ও কুসংস্কার থেকে বের করতে হলে শিক্ষার দরকার। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসি। এতে একটু হলেও তাদের মাঝে জ্ঞানের আলো পৌঁছাবে।’

পরিবার ও একটি পাঠাগার

বাড়ির পাশে ছোট্ট আরেকটি টিনের ঘরে চলে সুনীল গাঙ্গুলীর পাঠাগারের কার্যক্রম। ৬০০–এর মতো বই আছে পাঠাগারে। বইগুলো প্রতিদিন ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে রাখেন সুনীল কুমার। পাঠাগারটিতে তেমন কোনো আসবাব নেই। পাঠাগারের নাম কেন পুত্রবধূর নামে—এমন প্রশ্নের জবাবে বয়োবৃদ্ধ মানুষটি বললেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলের বউ প্রথম থেকেই আমাকে মায়ের মতো করে সেবাযত্ন করে। আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না। আমি মারা গেলে আমার নাতি যাতে তার মায়ের প্রতি ভালোবাসায় পাঠাগারটি আগলে রাখে, সে জন্যই তার নামে পাঠাগারটি করেছি।’

চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের পাঠক উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারের দীপক চন্দ্র। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র গাড়িতে গাড়িতে করে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেয়। আর আমাদের কোটালীপাড়ার ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হলেন সুনীল গাঙ্গুলী। সত্তরোর্ধ্ব জ্ঞানের এই ফেরিওয়ালা হেঁটে হেঁটে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিচ্ছেন হাসিমুখে। পাঁচ বছর ধরে আমি চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। অনেক দূরে এসে সুনীল গাঙ্গুলী আমাকে বই দিয়ে যান। বিনিময়ে কোনো টাকাপয়সা নেন না। তাঁর মতো ব্যক্তি সমাজে বিরল।’

সুনীল গাঙ্গুলীকে নিয়ে গর্বের কথা জানালেন কলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিজন বিশ্বাসও।

এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার উল্লেখ করে কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল যুগে সবাই ই-বুকে ব্যস্ত। সুনীল গাঙ্গুলীর এই প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের ছাপা বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।

আরও পড়ুন
শিক্ষার্থীদের হাতেও বই তুলে দেন সুনীল গাঙ্গুলী
ছবি: প্রথম আলো

বইপ্রেমী মানুষটির চাওয়া

সুনীল গাঙ্গুলী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। বয়স্ক লোক হলে তাঁকে ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। একটি বই দিয়ে বলেন, ‘বইটা পড়েন। আমি আগামী সপ্তাহে এসে জেনে যাব, বইটা কেমন লাগল।’ পরের সপ্তাহে জানতে চান বইটা শেষ হয়েছে কি না। বইটা পড়া শেষ হলে অন্য বই দিয়ে আসেন।

শিক্ষক ছিলেন একসময়। সুনীল গাঙ্গুলী কোনো বাড়িতে গেলে সবাই তাঁকে সম্মান করেন। তাঁকে বসিয়ে গ্রামের লোকজন তাঁর মুখে গল্প শুনতে ভালোবাসেন।

জ্ঞানপিপাসু মানুষের হাতে বই তুলে দিতে চান সুনীল গাঙ্গুলী। পিছিয়ে পড়া এই জনপদকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি।