পরচুলা তৈরি করে অভাব ঘুচিয়েছে ৭৫টি পরিবার

পরচুলা তৈরির কারখানায় কাজ তদারক করছেন লাইজু খাতুন। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বালাটারী গ্রামে গত শনিবার
ছবি: মো. জাহানুর রহমান

ছবি: মো. জাহানুর রহমানস্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায় লাইজু খাতুনের। স্বামী-সংসার দেখাশোনার পাশাপাশি চালিয়ে যান পড়ালেখা। স্নাতকোত্তর পাস করার পর চাকরির খোঁজ করতে থাকেন। তখন স্বামীর মাধ্যমে পরচুলা তৈরি প্রশিক্ষণের কথা জানতে পারেন। ভর্তি হয়ে যান সেখানে। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে এলাকায় এসে ১৬ জন নারীকে কাজ শেখান। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে ৭৫ জন নারী পরচুলা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বালাটারী গ্রামের বাসিন্দা মোছা. লাইজু খাতুন। তাঁর উদ্যোগে চালু হয়েছে পরচুলা তৈরির কারখানা ‘সিনহা বিনতে সামিউল হেয়ার ক্যাপ নিটিং লিমিটেড’। গত শনিবার বালাটারী গ্রামে লাইজু খাতুনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে খেলছে অনেক শিশু। তারা পরচুলা কারখানার নারীদের সন্তান। মায়েরা কারখানায় কাজ করছেন আর শিশুরা বাইরে খেলছে।

লাইজু একজন সাহসী নারী। উদ্যোক্তা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে। লাইজু সকল প্রতিবন্ধকতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছে।
সামিউল হক, লাইজু খাতুনের স্বামী

লাইজু জানান, উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের সামিউল হকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। স্নাতক পাসের পর থেকে স্বল্প টানাটানির সংসারে স্বামীকে সহায়তা করতে বিভিন্ন সংস্থায় কাজের জন্য আবেদন করতে থাকেন। ২০২০ সালে সরকারি পরীক্ষায় অংশ নিতে ঢাকায় যান। সে সময় ঢাকায় পরচুলা তৈরির ওপর একটি প্রশিক্ষণ সম্পর্কে সামিউল তাঁকে জানান। সে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাবার বাড়ি ফুলবাড়ীতে চলে আসেন। আসার সময় ঢাকা থেকে পরচুলা তৈরির জন্য কাঁচামাল সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। পরে ২০২১ সালে এলাকায় ১৬ জন নারীকে কাজ শেখানো শুরু করেন। এ সময় মূলধন ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা।

লাইজু বলেন, ‘প্রথম দিকে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাইনি। এলাকার নারী ও স্কুলের মেয়েশিক্ষার্থীদের দিয়ে খণ্ডকালীন কাজ করাতাম। নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করা দেখে এলাকাবাসী উপহাস করত। এ সময় কেউ কেউ বলাবলি করতে থাকল, আমরা শ্রমিকদের বেতন দেব না, কাজ করিয়ে নিয়ে পালাব। তখন অনেক কর্মী কাজ ছেড়ে দিল। সে সময় আমার স্বামীর মনোবল ভেঙে যায়। কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তবে আমি বাইরের লোকের কথায় কান দিইনি। বাবার জমি বন্ধক রেখে এবং স্বামীর বেতনের টাকা দিয়ে শ্রমিকের প্রথম বেতন পরিশোধ করি।’

তিনি বলেন, কারখানার প্রথম উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় পাঠালেন। তাঁরা দেড় লাখ টাকা মেরে দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। সে সময় আরও কিছু টাকা জোগাড় করে নতুন করে শুরু করলেন। সফলতাও পেলেন। ২০২২ সালের বাবার জমিতেই বড় করে পরচুলা তৈরির কারখানা বানান। এখন কারখানায় ৭৫ জন নারী কাজ করেন। একটি পরচুলা ক্যাপ তৈরি করতে আকারভেদে এক দিন থেকে দুদিন সময় লাগে। বাজারে আকারভেদে এর দাম তিন থেকে চার হাজার টাকা। বর্তমানে কারখানার একেকজন কর্মী মাসে সাত হাজার থেকে নয় হাজার টাকা আয় করেন।

লাইজুর স্বামী সামিউল হক বলেন, ‘লাইজু একজন সাহসী নারী। সরকারি চাকরির পেছনে না ছুটে সে এলাকার নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য পরচুলা তৈরির কারখানা দিয়েছে। উদ্যোক্তা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে। লাইজু সকল প্রতিবন্ধকতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছে।’

পরচুলা কারখানার খণ্ডকালীন শ্রমিক মুক্তা খাতুন। সে ফুলবাড়ী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। তার মা তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে পড়ালেখা করতে চায়। তার দাদি ও সে বর্তমানে আলাদা থাকে। মুক্তা খাতুন বলে, ‘আমি কারখানায় সপ্তাহে দুদিন কাজ করি। এখান থেকে যা টাকা পাই, সেটা দিয়ে আমি আমার পড়াশোনার খরচ চালাই, অতিরিক্ত টাকা দাদির সংসারে দিই। এখন আর আগের মতো পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করি না। পরিবারেও অভাব দূর হয়েছে।’

চন্দ্রখানা গ্রামের শ্রমিক মোছা. নাসিমা খাতুন (২৬)। তার ভূমিহীন কৃষক স্বামী অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। দুই ছেলে-মেয়ে। অভাবের সংসার। প্রতিবেশীর মাধ্যমে লাইজু খাতুনের কারখানার কথা শুনে এখানে ছুটে আসেন। বর্তমানে নাসিমা খাতুনের সঙ্গে তাঁর মেয়েও পড়ালেখার পাশাপাশি এই কারখানায় কাজ করেন। মা–মেয়ে মিলে মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন পান। বর্তমানে বাবার দেওয়া চার শতক জায়গায় টিনশেড ঘর তুলেছেন। জমি বন্ধক নিয়ে দিয়েছেন।

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. সোহেলী পারভীন বলেন, তিনি লাইজু খাতুনের কারখানার কথা জানেন। সেখানে এলাকার অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে তাঁর কারখানার জন্য যদি কিছু করা যায়, সে ব্যবস্থা করবেন।