জাকিউরের বাগানে সারা বছরই আম পাওয়া যায়

বাগানে কাটিমন আমের যত্ন নিচ্ছেন জাকিউর আলম। গত শুক্রবার দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার পূর্ববর্ষা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

আমগাছের একটি ডালে ফুটেছে মুকুল। সেখানে ভিড় করেছে মৌমাছি। ওই গাছেরই আরেক ডালে ঝুলছে আম। হালকা সবুজ রঙের প্রতিটি আমের ওজন গড়ে ৩৫-১০০ গ্রাম। মে–সেপ্টেম্বর মাস আমের মৌসুম হিসেবে পরিচিত। তবে এই বাগানে সারা বছরই আম পাওয়া যায়। অসময়ে আসা এই জাতের আমের নাম ‘কাটিমন’। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে এই আম বাজারে বিক্রি করা যাবে।

আমবাগানটির দেখা মিলবে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার পূর্ববর্ষা গ্রামে। বাগানমালিকের নাম জাকিউর আলম ওরফে জাকির (৪১)। তিনি কাহারোল উপজেলার জোত মুকুন্দপুর গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে।

২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করে বাবার ধান–চালের ব্যবসার হাল ধরেন জাকিউর আলম। কিন্তু ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারেননি। কয়েক মাস পরেই পৈতৃক তিন বিঘা জমিতে শখ করে বারি-৪ জাতের এক হাজার আমের চারা লাগিয়ে বাগান করেছিলেন। পরের বছর ২০১৭ সালে তিন লাখ টাকার আম বিক্রি করেন। এরপর শখ হয়ে ওঠে পেশা এবং নেশা। বর্তমানে ৬৯ বিঘা জমিজুড়ে জাকিউরের আমবাগান। আম্রপালি, বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ক্ষীরশাপাতি, থ্রি টেস্ট, হিমসাগর, কাটিমন, ল্যাংড়া, গৌড়মতি, ইলাবতীসহ বিভিন্ন জাতের ৩০ হাজারেরও বেশি আমগাছ রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ বিঘা জমিতে কাটিমন জাতের আমগাছ রয়েছে ৩ হাজার ৮০০টি। আগামী দেড় মাসের মধ্যে ৪৫ লাখ টাকার শুধু কাটিমন আম বিক্রি হবে—এমনটিই প্রত্যাশা জাকিউরের।

গত শুক্রবার জাকিউরের আমবাগান ঘুরে দেখা যায়, ৬-১০ ফুট উচ্চতার গাছগুলোর প্রায় প্রতিটি ডালে আম ও মুকুল বাতাসে দোল খাচ্ছে। উচ্চতা কম রাখতে নিয়মিত ডাল ছাঁটাই করা হয়। তাই গাছগুলোকে দূর থেকে দেখে মনে হয় মেলে থাকা ছাতা। পোকামাকড় থেকে সুরক্ষা এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে আমগুলো বিশেষ কার্বন ম্যাঙ্গো ব্যাগ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাঁশের খুঁটি দিয়ে হেলে পড়া ডালগুলো ঠেক দেওয়া হয়েছে। পোকা ও মাছির আক্রমণ রোধে কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে হলুদ আঠালো স্টিক ও ফেরোম্যান সেক্স ট্র্যাপ বসানোর কাজ করছেন শ্রমিকেরা। গাছের গোড়া পরিষ্কার ও সেচের কাজ করছেন কেউ। ফল ও গাছের সুরক্ষায় মরা ডাল ও পাতা ছাঁটাই করা হচ্ছে।

বর্তমানে ৬৯ বিঘা জমিজুড়ে জাকিউরের আমবাগান। আম্রপালি, বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ক্ষীরশাপাতি, থ্রি টেস্ট, হিমসাগর, কাটিমন, ল্যাংড়া, গৌড়মতি, ইলাবতীসহ বিভিন্ন জাতের ৩০ হাজারেরও বেশি আমগাছ রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ বিঘা জমিতে কাটিমন জাতের আমগাছ রয়েছে ৩ হাজার ৮০০টি।

আম নিয়ে জাকিউরের যত ধ্যানজ্ঞান। কখনো বাগানে, কৃষি অফিসে, কখনো আবার ইন্টারনেট ঘেঁটে আম নিয়ে পড়াশোনা করেন। জাকিউর জানান, মাঝেমাঝে দিন কয়েকের জন্য বেরিয়ে পড়েন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরাসহ আম চাষ হয় এমন সব এলাকা ঘুরে আসেন। সেখানকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলেন। নতুন নতুন আমের জাতের সন্ধান করেন।

মৌসুমে প্রথমে আম্রপালি জাতের আম বিক্রি করেন জাকিউর। আর মৌসুমের শেষ দিকে (আগস্টের শুরুতে) বাজারে আনেন বারি-৪ জাতের আম। জাকিউর বলেন, ‘বাজারে যখন অন্য কোনো আমের জোগান থাকে না, ঠিক তখনই বারি-৪ জাতের আম বিক্রি শুরু করি। তবে গত দুই বছরে এই আমের বাজার কমেছে; তাই প্রতি তিন সারি গাছ থেকে এক সারি কেটে ফেলেছি। ওই সারিতে এখন লাগানো হয়েছে কাটিমন। কাটিমনের বাজার ভালো, তা ছাড়া বছরজুড়ে ভোক্তাকে আম খাওয়াতে পারছি।’ তিনি জানান, বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ কাটিমন আমের দাম ১৫-১৮ হাজার টাকা। বাগানে অন্তত ৩০০ মণ আম আছে। হিসাব অনুযায়ী, ৪৫ লাখ টাকার আম বিক্রি করবেন আগামী দেড় মাসের মধ্যে। তবে শেষ সময়ে বাগান পরিচর্যায় যে ব্যয় হচ্ছে তাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। স্থানীয় একটি সরকারি ব্যাংক পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে।

মাছি ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমে পরানো হচ্ছে বিশেষ কার্বন ম্যাঙ্গো ব্যাগ। গত শুক্রবার দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার পূর্ববর্ষা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কাটিমন আম বিষয়ে গাজীপুর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরফ উদ্দিন জানান, কাটিমন আমের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গাছে মুকুল আসাটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ফলে একই সঙ্গে গাছে মুকুল দেখা যায়, আবার ফলও কর্তন করা যায়। চারা রোপণের দেড় বছরের মধ্যে মুকুল আসা শুরু করে। একেকটি আমের ওজন হয় ১৫০-৪৫০ গ্রাম। এই আমের চামড়া খুব পাতলা, আঁশ ছোট, খেতেও সুস্বাদু ও মিষ্টি। আকারে লম্বাকৃতির। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী হয় এবং হলুদ রং ধারণ করে। এই আমের ৭৮ শতাংশ খাওয়া যায়। অনায়াসে ১০-১২ দিন সংরক্ষণ করা যায়। হেক্টরপ্রতি ফল পাওয়া যায় ১২-১৫ মণ।

শুক্রবার জাকিউরের বাগানে বেড়াতে এসেছিলেন মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘পাশেই একটা বিয়েবাড়িতে এসেছি। শুনলাম, এখানে বারো মাস আমগাছে আম ধরে। দুই বন্ধু দেখতে আসছি। দূর থেকে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। কাছে এসে দেখলাম কীভাবে আমগুলোকে প্যাকেট করে রাখা হয়েছে। বাগানমালিক একটি আম খেতেও দিয়েছেন। খুবই ভালো লাগছে এত বড় আমবাগান দেখে। অসময়ে পাকা আমও খেতে পারলাম।’

বাজার বুঝে বিভিন্ন উন্নত জাতের আমগাছ দিয়ে বাগান সাজিয়েছি। বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন আমের জাত আবিষ্কার করছেন, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখছি।
জাকিউর আলম, আম বাগানের মালিক

আমবাগানে সফলতা পেয়েছেন জাকিউর। আট বছরের ব্যবধানে বাগানের আয় দিয়ে ৩৫ বিঘা জমি কিনেছেন। ছাদবিশিষ্ট পাকা বাড়ি তুলেছেন গ্রামে। গরুর খামার করার কাজে হাত দিয়েছেন। জাকিউর বলেন, ‘বাজার বুঝে বিভিন্ন উন্নত জাতের আমগাছ দিয়ে বাগান সাজিয়েছি। বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন আমের জাত আবিষ্কার করছেন, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখছি। অনেকে ফলের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে ফল দ্রুত পাওয়া যায়; ওজনও বেশি হয়। এতে গাছের স্বাস্থ্যহানি ঘটে; দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। এটা আমচাষিদের বোঝা উচিত।’ তিনি পোকা ও মাছির আক্রমণ প্রতিরোধে কীটনাশকের পরিবর্তে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেন।