২৫০ প্রজাতির ১২০০ গাছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে উঠছে সবুজ
একসময় ছিল জলাভূমি। অধিগ্রহণের পর ভরাট করা হয় বালু দিয়ে। যাত্রা শুরু হয় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস তৈরির কাজ। তৈরি হতে থাকে আকাশছোঁয়া নান্দনিক সব ভবন। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ছিল ক্যাম্পাস সবুজ হবে। কিন্তু বালুর কারণে ক্যাম্পাসের মাটিতে গাছ রোপণের পর বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসকে সবুজ প্রাঙ্গণে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত মে মাস থেকে শুরু হয়েছে বিশেষ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। নান্দনিক পরিকল্পনায় ক্যাম্পাসে রোপণ করা হয় ফলদ, বনজ, ঔষধি, বিভিন্ন জাতের ফুল ও শোভাবর্ধক ২৫০ প্রজাতির ১ হাজার ২০০ গাছের চারা। ফলে মাত্র আট মাসেই পুরো ক্যাম্পাস নিয়েছে নতুন রূপ। হয়ে উঠেছে সবুজ প্রাঙ্গণ। ছড়াচ্ছে প্রশান্তির নতুন সুর।
এখানে পাখি আসবে। শিক্ষার্থীরা ফল খাবে, ফুল দেখবে, সবুজ বৃক্ষের ছায়ায় বসবে, গাছ নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করবে, এমন পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে নিচু জলাভূমি ভরাটের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তৈরির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় অবকাঠামো নির্মাণ। উঠে দাঁড়ায় আকাশছোঁয়া বড় বড় ভবন। কিন্তু কিছুতেই ক্যাম্পাসকে সবুজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বালু ভরাটের কারণে এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে ক্যাম্পাসে কিছু চারা রোপণ করলেও সেগুলো মারা যায়। ফলে বর্তমান প্রশাসন ৩০ একরের ক্যাম্পাসকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য বিশেষ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল বিভাগ এবং স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষকসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ছয় সদস্যবিশিষ্ট বৃক্ষরোপণ কমিটি গঠন করা হয়। পুরো কাজটি তত্ত্বাবধান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম।
কমিটির সদস্যরা জানান, তাঁরা বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির শুরুতেই ক্যাম্পাসের মাটি পরীক্ষা করেন। এরপর ৩০ একর ক্যাম্পাসকে ১ হাজার ২০০টি জোনে ভাগ করেন। এসব জোন থেকে আট ঘনফুট বালু তুলে ফেলে সেখানে গোবর, দোঁআশ মাটি দিয়ে এক মাস আগে থেকে জায়গা প্রস্তুত করা হয়। এসব জায়গা বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর চারা রোপণ শুরু হয়। দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ, জীববৈচিত্র্য, দুর্লভ গাছের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন মাথায় রেখে সংগ্রহ করা হয় ২৫০ প্রজাতির ১ হাজার ২০০ গাছ। পরে সেগুলো রোপণ করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন দেখা যায়, শীতের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে পুরো ক্যাম্পাস। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই সড়কের দুই পাশের নাম না–জানা ছোট ছোট গাছের ডালপালা মাথা নাড়িয়ে যেন স্বাগত জানাচ্ছে আগতদের। সর্বত্র রোপিত ছোট ছোট গাছের পাতাগুলো মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে। ছোট–বড় গাছ, নানা রঙের ফুলে তৈরি হয়েছে এক নান্দনিক পরিবেশ। প্রবেশ করেই হাতের ডানে বিশাল মাঠ, সুন্দর লেক, চারদিকে রোপিত চারার অনন্য সৌন্দর্যের প্রশান্তি টের পাওয়া গেল। নতুন রোপণ করা গাছগুলো পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রমিকেরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মো. নজরুল ইসলাম জানান, ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণের প্রধানতম উদ্দেশ্য সবুজায়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা। নাটোরের লালপুরসহ পাবনা উষ্ণ এলাকা হিসেবে ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড গরম পড়ে। পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ তাপমাত্রা কমাতে পারে। জীববৈচিত্র্য মাথায় রেখে এবং হারিয়ে যাওয়া গাছের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করাতেই তাঁরা দুর্লভ গাছ সংরক্ষণের বিষয়টি পরিকল্পনায় আনেন। এরপর পাবনার সরকারি বন বিভাগ ছাড়াও ঢাকার মিরপুর বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন নার্সারি, চট্টগ্রাম, খুলনা, বান্দরবান, টাঙ্গাইল বোটানিক্যাল গার্ডেন, সাভার, নাটোর, চাটমোহর থেকে চারা সংগ্রহ করা হয়।
গাছের তালিকায় রয়েছে দুর্লভ ধুপ, উরি আম, মধুমাধবী, হাপরমালী, কানাইডিঙ্গা, বাঁশপাতা, নাগলিঙ্গম, রক্তন, চিকরাশি, বোলা, তমাল, নাইচিচা উদাল, বৈলাম, পুন্নাগ, কুসুম, কুরচি, মুচকুন্দ চাঁপা, পালাম, রক্তরাগ, করঞ্জ, পরশপিপুল, কৃঞ্চ বট, পলকজুঁই, বুদ্ধনারকেল, নীল অঞ্জন, রয়না, রিঠা, কুম্ভী, আঁশফল ও পুত্রঞ্জীব।
নজরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে গাছগুলো রোপণ করা হয়েছে। এখানে পাখি আসবে। শিক্ষার্থীরা ফল খাবে, ফুল দেখবে, সবুজ বৃক্ষের ছায়ায় বসবে, গাছ নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করবে, এমন পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে প্রচলিত বনজ, ফুল-ফলের গাছের পাশাপাশি ঔষধি গাছের বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে।
ক্যাম্পাস থেকে বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী হোসাইন আহমেদ বলেন, ‘রোপণ করা গাছের চারার সঙ্গে সঙ্গে বড় হবে আমাদের স্বপ্ন, সম্ভাবনা, অগ্রযাত্রা। আমাদের শেখাবে পরিচর্যা, মমতা ও দায়িত্ববোধ। ক্যাম্পাস হবে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সময়ের জন্য আদর্শ স্থান। ফলে উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম আবদুল আওয়াল বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা হলো কংক্রিটের পাশাপাশি ক্যাম্পাস সবুজ থাকবে। সে জন্য বিভিন্ন ভবনের সৌন্দর্যের সঙ্গে সংগতি রেখে উপযুক্ত গাছ রোপণ করছি। এর মাধ্যমে পরিবেশগত উপকারিতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বাড়াবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের উদ্যোগ কাজে লাগবে বলে মনে করি। সেই সঙ্গে এই ক্যাম্পাসের আলোয় পুরো বাংলাদেশ আলোকিত হবে—এ প্রত্যাশা রাখি।’