বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে নিখোঁজ, ১৫ বছর পর বাড়ি ফিরলেন মোস্তাফিজ

১৫ বছর পর নিখোঁজ মোস্তাফিজকে (ছবিতে মাঝখানে) পেয়ে আনন্দিত স্বজনেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার পালগিরি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

১৫ বছর আগে নিজের বিয়ের জন্য স্বজনদের সঙ্গে কেনাকাটা করতে বাড়ি থেকে ফেনী শহরে গিয়ে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর অনেক খুঁজেও তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় তাঁকে পাওয়া গেছে। মোস্তাফিজকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে ভাসছে তাঁর পরিবার।

মোস্তাফিজুর রহমান (৪৫) ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের পালগিরি গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। ১৫ বছর ধরে রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় অবস্থান করা এই ব্যক্তি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খোকা নামে পরিচিত ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মোস্তাফিজকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন তবলছড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. মোস্তফাসহ স্থানীয় মসজিদ ও সমাজ কমিটির লোকজন।

মোস্তাফিজুর রহমানের বোন বিবি রহিমা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে তাঁর ভাই মোস্তাফিজুর রহমানকে বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী ঠিক করেন। এরপর একদিন বিকেলে মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা বেশ কয়েকজন বিয়ে ও গায়েহলুদের কাপড় কেনার জন্য বাড়ি থেকে ফেনী শহরে যান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় তাঁরা বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। এমন সময় মোস্তাফিজ শহরের একটি শৌচাগারে যান। দীর্ঘক্ষণেও না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা তাঁকে খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু মোস্তাফিজকে আর পাওয়া যায়নি। পরে তাঁরা থানায় গিয়ে একটি নিখোঁজের ডায়েরি করেন।

বিবি রহিমা আরও বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁদের বাড়ির পাশের মো. আকাশ নামের এক ব্যক্তি ব্যবসায়িক কাজে রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় গিয়ে মোস্তাফিজকে একটি চা–দোকানে চা পান করতে দেখেন। এ সময় আকাশ তাঁকে চিনতে পেরে কাছে গিয়ে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুই বলতে পারেননি। পরে আকাশ তাঁর মুঠোফোনে মোস্তাফিজের একটি ছবি তুলে বাড়িতে পাঠান। বাড়ির লোকজন ও আত্মীয়স্বজন ছবি দেখে হারিয়ে যাওয়া মোস্তাফিজকে শনাক্ত করেন। এরপর আকাশ মোস্তাফিজকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে তবলছড়ি এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। গতকাল দুপুরে স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু সুফিয়ানসহ আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে রাঙামাটি তবলছড়ি কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় মো. মোস্তফা নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে যান বিবি রহিমা। পরে মোস্তাফিজকে পরিবারের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ বছর আগের কোনো কথা বা স্মৃতি তাঁর মনে নেই।

মোস্তাফিজের মা নুরজাহান বেগম (৭০) বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর আমার কলিজার টুকরা সন্তানের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতিদিন রাতে তার থাকার ঘরের বিছানা ঠিক করে দিতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার ছেলে আমার কোলে আসবে। আমি মনে করেছিলাম সে অনেক কষ্টে আছে। কিন্তু তাকে রাঙামাটির লোকজন খুব আদর করে যত্নে রেখেছিল। তার বিয়ের জন্য ঠিক করা ওই পাত্রীর পরিবারও প্রায় তিন-চার মাস অপেক্ষা করেছিল। এরপর তাকে খুঁজে না পাওয়ায় ওই পাত্রীকে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে।’

রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় মো. মোস্তফা নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মোস্তাফিজুর রহমান (খোকা) ২০০৯ সালে রাঙামাটি তবলছড়ি এলাকায় আসেন। তিনি নিজের সম্পর্কে ও পরিবার সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন খোকা এলাকার সবার কাছে হয়ে ওঠেন ঘনিষ্ঠজন। মাঝেমধ্যে এলাকার মানুষের ঘরে গিয়ে ভাত বা টাকা খুঁজতেন তিনি। পরে মোস্তফা তাঁকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকা আগের কিছুই মনে করতে ও বলতে পারতেন না। ১৫ বছর পর হলেও খোকাকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত।

মো. মোস্তফা আরও বলেন, ‘বিদায়বেলায় খোকার জন্য মন কেঁদে উঠেছে। মানসিক ভারসাম্যহীন এই ব্যক্তি আমাদের পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলেন। তিনি পরিবারকে খুঁজে পেয়েছেন, এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।’