যে প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মেয়র
যে প্রকল্পটি নিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন, সেটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি আনার জন্য গাড়ি ও যন্ত্রপাতি কিনতে চার বছর আগে একটি প্রকল্প নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়নি সরকার। অবশেষে এখন রাজি হলেও প্রকল্প ব্যয়ের ৬০ শতাংশ অর্থ দেবে ঋণ হিসেবে। বাকি ৪০ শতাংশ অনুদান হিসেবে পাবে সিটি করপোরেশন। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো সরকারি ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে সংস্থাটি। এর আগে সরকারি অনুদান ও নিজস্ব তহবিলে প্রকল্পের কাজ করেছে সিটি করপোরেশন। এখন ঋণের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের শর্তে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন।
গত সোমবার সিটি করপোরেশনের বাজেট অধিবেশনে মেয়র বলেন, ‘মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। ঋণের সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত। সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয় যে সুদ দেবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ যেমন কমবে, তেমনি নগরও পরিচ্ছন্ন থাকবে।’ এর আগে অন্তত আরও দুটি সভায় এ প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যয় কমানো নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মেয়র।
মেয়র সিটি করপোরেশনের বাজেট অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশ করেননি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের শর্ত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। প্রকল্পটি এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে বলে জানান সিটি করপোরেশনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
যে প্রকল্পটি নিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন, সেটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে ২০২১ সালের আগস্টে যখন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ওই সময় প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক। পরে তাঁকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বদলি করে দেওয়া হয়। এরপর সিটি করপোরেশন প্রকল্পটি নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্পের অর্থায়ন বিষয়ে গত ৫ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আছিয়া খাতুন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের জিওবি (সরকারি অনুদান) অংশের ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার মধ্যে ৬০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। এর পরিমাণ ১৬১ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর বাকি ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১০৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে চট্টগ্রামে মেয়র পদে পরিবর্তন আসে। নতুন মেয়রের দায়িত্ব নেন বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন। কিন্তু অর্থ বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণের শর্ত দিলে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কী আছে অর্থ বিভাগের চিঠিতে
‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্পের অর্থায়ন বিষয়ে ৫ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আছিয়া খাতুন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের জিওবি (সরকারি অনুদান) অংশের ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার মধ্যে ৬০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। এর পরিমাণ ১৬১ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর বাকি ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১০৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে।
‘জলাবদ্ধতার জন্য এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি। খাল-নালা পরিষ্কারের মেশিনারিজ যদি না থাকে, কীভাবে জলাবদ্ধতার এত বড় বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব। পুরোনো মেশিন দিয়ে নিতে গিয়ে ভেঙে যাচ্ছে’
এ ক্ষেত্রে সাতটি শর্ত দেওয়া হয়। প্রথম শর্তে বলা হয়, সরকারি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ বছর। তিন মাস অন্তর অন্তর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে ঋণ নেওয়া ও কিস্তি শোধ শুরুর মধ্যকার বিরতি (গ্রেস পিরিয়ড) হিসেবে পাঁচ বছর সময় অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত প্রথম কিস্তি পাওয়ার পরের পাঁচ বছরকে গ্রেস পিরিয়ড ধরা হয়। তিন নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে অর্থ বিভাগের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি করতে হবে। চার নম্বর শর্ত হলো—প্রস্তাবিত ব্যয় মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নিজস্ব তহবিলের অংশের ব্যয় নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে পাঁচ নম্বর শর্তে। ছয় নম্বর শর্তে প্রতিবছর নিরীক্ষা প্রতিবেদন যথাসময়ে পরিশোধ করার কথা এবং সাত নম্বর শর্তে ঋণের টাকা নিয়মিত পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।
১৬১ কোটি ৯ লাখ টাকা আসলের পাশাপাশি মোট সুদ দিতে হবে ১২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০ বছরে সিটি করপোরেশনকে পরিশোধ করতে হবে ২৮৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশনকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের শর্ত বেঁধে দিলেও সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে দেনায় জর্জরিত। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের মোট দেনার পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় নতুন করে ঋণ নিলে তা পরিশোধের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের শর্তে ক্ষুব্ধ মেয়র
বাজেট অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করার আগে ২৪ মে সিটি করপোরেশনের এক সেমিনারে প্রকল্পটি অনুমোদন ও বরাদ্দ না পাওয়ায় ক্ষোভ এবং হতাশা প্রকাশ করেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। ‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘২০২২ সালে (প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সালের আগস্টে) ৩৯৮ কোটি টাকার একটা প্রকল্প জমা দেওয়া হয়। সেটা যেভাবে আছে, ওভাবে ওখানে পড়ে আছে। আমি বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর একটা জায়গায় এসেছে। ফাইনালি সেটা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা কাটিয়ে ২৯৮ কোটি (এখন ২৬৮ কোটি টাকা) টাকা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁকে বলেছি জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে এই প্রকল্প দিতে হবে। আমার যন্ত্রপাতি দরকার। যে যন্ত্রপাতি আছে সেগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরোনো। এ মেশিনগুলো নিয়ে যখনই কাজ করতে যাই ফেল করছে সেখানে। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন—দেখছেন।’
এখনো প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় হতাশ মেয়র বলেন, ‘জলাবদ্ধতার জন্য এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি। খাল-নালা পরিষ্কারের মেশিনারিজ যদি না থাকে, কীভাবে জলাবদ্ধতার এত বড় বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব? পুরোনো মেশিন দিয়ে নিতে গিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।’ মেয়র আরও বলেন, ‘আমার জলাবদ্ধতায় বাজেট কী দিয়েছে? পাঁচ কোটি টাকা নালা পরিষ্কার করার জন্য। আড়াই কোটি টাকা একটা বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের জন্য। দ্যাটস অল। ৮ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা সংস্কার করার জন্য দিয়েছে। আমরা এগুলো চাইনি। আমরা চেয়েছি মেশিনারিজ কেনার জন্য ৩০০ কোটি টাকা। অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছি।’
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জলাবদ্ধতা নিরসনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায়ও প্রকল্পটি অনুমোদন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম।
কী কী যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা
এই প্রকল্পের আওতায় বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও পরিষ্কারের জন্য যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে ৫টি পিকআপ, ৬৫টি বিভিন্ন আকৃতির ডাম্প ট্রাক, ৪টি ব্যাক হো লোডার, ৯টি হুইল লোডার, ১টি স্কিড স্টিয়ার লোডার, একটি উভচর খননযন্ত্র (অ্যাম্পিবিয়াস এক্সকাভেটর), ৮টি বিভিন্ন আকারের খননযন্ত্র, ২১টি মিনি গার্বেজ ট্রিপার, ১টি রোড সুইপিং মেশিন, ৫টি গার্বেজ কমপেক্টর, ভ্রাম্যমাণ বর্জ্য কনটেইনার ২০০টি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ান উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনের যন্ত্রপাতির সংকট চলছে। যে যন্ত্রপাতিগুলো আছে, তা পুরোনো হওয়ায় কাজ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হলে সিটি করপোরেশনের কাজে গতি আসবে।