‘হায়রে, রেলগাড়ি দেখা হইল না আমার কলিজাগুলার’

নিহত আফিয়া জান্নাত ও আবদুর রহমানছবি সংগৃহীত

ঘরের বারান্দায় বসে অঝোরে কাঁদছিলেন রাবেয়া আক্তার। একমাত্র ছেলে ও এক মেয়ের একসঙ্গে মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা তাঁর। বারবার বলছিলেন—‘রেলগাড়ি দেখার কত শখ ছিল, শখ পূরণ করতে গিয়েই আমার সন্তানদের প্রাণ গেল।’ এরপর বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘হায়রে, রেলগাড়ি দেখা হইল না আমার কলিজাগুলার।’

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ঘর থেকে ট্রেন দেখতে বের হয়ে মহাসড়কে বাসের চাপায় মৃত্যু হওয়া দুই শিশুর বাড়িতে গিয়ে গতকাল শুক্রবার এই দৃশ্য চোখে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার মৃত্যু হয় উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ার সৌদিপ্রবাসী নাছির উদ্দিন ও রাবেয়া আক্তারের দুই সন্তান আফিয়া জান্নাত (৮) ও আবদুর রহমানের (৬)।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে ইট বিছানো সড়ক বেয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটাপথে সৌদিপ্রবাসী নাছির উদ্দিনের বাড়ি। একতলা বাড়িটির এখনো আস্তরণ দেওয়া হয়নি। বেলা তিনটার দিকে বাড়িটিতে গিয়ে কথা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

নিহত দুই শিশুর মা রাবেয়া আক্তার বলেন, তাঁর প্রথম তিন সন্তানই মেয়ে। এরপর আবদুর রহমানের জন্ম। তাই রহমানকে সবাই বলত বংশের প্রদীপ। পুরো ঘর সে একাই মাতিয়ে রাখত। ছেলে জন্ম হওয়ার পর তাঁর স্বামী একটি পাকা ঘর করার স্বপ্ন দেখেন। গত দুই বছর ধরে সেই স্বপ্নপূরণের কাজ চলছিল। কিন্তু ঘর যখন প্রায় প্রস্তুত তখন তাঁর পাকা ঘর ফাঁকা করে দিয়ে একমাত্র ছেলেসহ দুই সন্তানের মৃত্যু হলো।

কথা বলতে বলতে আবারও বিলাপ করতে থাকেন রাবেয়া। বলতে শুরু করেন, ‘ও রহমান, অ পুত আঁই হারে লই দিন হাডাইয়ুম। তুই আঁরে ফেলাই কেনে গিয়সগই অ পুত। (ও রহমান, আমি কাকে নিয়ে দিন কাটাব। তুই কীভাবে আমাকে ফেলে চলে গেলি।)’

রাবেয়া বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরুর পর আবদুর রহমান একটি খেলনা রেলগাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য মুঠোফোনে তার বাবার কাছে বায়না ধরে। ছেলের জন্য বাবা রেলগাড়ি কিনেও রেখেছেন। সেটি সন্তানের হাতে তুলে দেওয়া আর সম্ভব হলো না।

রাতে ঘুমানোর সময় রহমানের ভয় লাগত বলে সারা রাত ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো জানিয়ে রাবেয়া বিলাপ করতে থাকেন, ‘অ পুত, আঁধারত ক্যানে থাকিবি? তুই তো আঁরে ছারা ন থাকিতি। এহন ক্যানে থাকর?’ (বাবা, অন্ধকারে কীভাবে থাকবি? তুই তো আমাকে ছাড়া থাকতি না। এখন কীভাবে থাকছিস?)

মেয়ের প্রসঙ্গ টেনে রাবেয়া বলেন, আফিয়া বাবার সঙ্গে ফোনে খুবই কম কথা বলত। গত বুধবার সন্ধ্যায় হঠাৎ বাবার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। বাবাকে বলে লিপস্টিক, স্কুলে যাওয়ার জুতা, ব্যাগ এবং হিজাব আনতে। মেয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলায় তার বাবাও খুব খুশি হয়েছিল। আগামী রমজান মাসে দেশে ফিরে সন্তানদের এসব জিনিস তুলে দেওয়ার আশা করেছিল তাদের বাবা। সব আশা শেষ। একটি বাস সব স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছে।

আফিয়া ও রহমানের বাইরে নাছির-রাবেয়া দম্পতির আরও তিন সন্তান রয়েছে। তাঁদের বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণি, মেঝ মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট মেয়েটির বয়স ১৩ মাস।

রাবেয়ার শাশুড়ি শহর বানু বলেন, ‘নাছিরসহ আমার অন্য ছেলেদেরও কারও ছেলেসন্তান নেই। তাই রহমানকে সবাই বংশের প্রদীপ বলতাম। বাসচাপায় আমার আরেক ছেলে আবদুল গফুরের এক মেয়েও আহত হয়েছে। তার জ্ঞান ফিরলেও এখনো মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়নি।’