শুধু রেলপথটিই আর নেই...
এখনো দাঁড়িয়ে আছে রেলওয়ের গুমটিঘর। এ কারণে সাগুয়ান নামের সঙ্গে গুমটি শব্দটি যোগ হয়ে গ্রামের নাম হয়ে গেছে সাগুয়ানঘুন্টি। ছিল রেলওয়ের স্টেশনও। বেদখল হয়ে গেছে। আছে রেলগেট মসজিদ, জিআরপি মসজিদ, রেলওয়ের গুদাম। স্থানীয় বাজারের নাম এখনো রেলবাজার। শুধু রেলপথটি নেই।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ এখন শুধুই স্মৃতি। রেলওয়ের সম্পত্তিও সব বেদখল। নেই উদ্ধারের কোনো তৎপরতাও।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ১৯০৯ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে বিহারের কাটিহার শাখা রেলওয়ের অধীনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ঘাট থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা ও রহনপুর হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গাবাদ ও মালদহ পর্যন্ত মিটারগেজ সেকশন চালু করে। এই পথের যাত্রীরা ব্রডগেজ ট্রেনে করে শিয়ালদহ থেকে লালগোলা ঘাটে (পদ্মার দক্ষিণ তীর) আসতেন। পরে রেলফেরি কর-ঘাট পার হয়ে পদ্মার উত্তর তীরে গোদাগাড়ী ঘাটে অপেক্ষমাণ মিটারগেজ ট্রেনে উঠতেন। এই ট্রেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, কাটিহার, শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গে যেত।
১৯৪৭ সালের পর দেশভাগ হলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ঘাট থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা হয়ে রহনপুর পর্যন্ত অংশ বিছিন্ন ছোট মিটারগেজ সেকশনে পরিণত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার আমনুরা-রহনপুর পর্যন্ত মিটারগেজ সেকশন ব্রডগেজে রূপান্তর করে। কারণ, রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা পর্যন্ত ছিল ব্রডগেজ লাইন। এদিকে গোদাগাড়ী ঘাট থেকে আমনুরা জংশন পর্যন্ত মিটারগেজে থেকে যায় এবং দেশভাগের ফলে যাত্রী কমে যাওয়ায় এই মিটারগেজ সেকশন অলাভজনক হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে এই ২৩ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার মিটারগেজ সেকশন তুলে ফেলা হয়। ৬০ দশকের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সিঙ্গাবাদ পর্যন্ত তাঁদের মিটারগেজ সেকশন ব্রড গেজে রূপান্তরিত করে ভারত। আশির দশকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রহনপুর স্টেশন থেকে বর্ডার হয়ে সিঙ্গাবাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর মহল্লায় ছিল গোদাগাড়ী ঘাট রেলস্টেশন। পাশেই ছিল রেলওয়ের গুদামঘর। বর্তমান গোদাগাড়ী-রাজশাহী সড়কের পাশের এলাকায় রেলগেট ছিল। এখনো ওই এলাকার নাম রেলগেট। রেলগেট থেকে রেলস্টেশনের আশপাশের এলাকার বাজার ছিল। সেই বাজারের এখনো রেলবাজার নামে পরিচিত।
রেলস্টেশনটি ছিল পদ্মা নদীর ধারে। সেখানে ট্রেন ইঞ্জিন ঘুরিয়ে আবার আমনুরা জংশনের দিকে যেত। তবে স্টেশনটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রেলগেট এলাকা হয়ে নদীর ধারে যেতেই চোখে পড়ল একটি মসজিদ। গায়ে লেখা ‘রেলগেট মসজিদ’। পাশের পাড়ায় আরেকটি মসজিদ—নাম ‘জিআরপি মসজিদ’।
স্থানীয় প্রবীণদের ভাষ্য, এখানে রেলওয়ের অনেক জমি আছে। সব দখল করে স্থানীয় লোকজন বাড়িঘর করে ফেলেছেন। তবে রেলের গুদামটি এখনো সরকারের দখলে রয়েছে। এটি এখন ‘এলএসডি’ গোডাউন। স্থানীয় খাদ্যগুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এই গুদামের পেছনের পদ্মার ঘাটে দেখা হয় মুনিরুল ইসলাম (৫৫) নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর চোখের সামনে স্টেশনটি দখল হয়ে গেছে। এখানে ট্রেনের ইঞ্জিন শান্টিং দেওয়ার অনেক জায়গা ছিল, সবই এখন বেদখল।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, রেলওয়ের জমিতে তিনটি বাড়ি করেছেন গোদাগাড়ী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনিরুল ইসলাম ও তাঁর ভাইয়েরা। এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার সবাই রেলের জমিতেই বাড়ি করে আছেন।’
পরিত্যক্ত রেলপথের সম্পত্তির কথা জানতে চাইলে পশ্চিম রেলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, গোদাগাড়ীতে রেলের অনেক সম্পত্তি। এগুলো দখলমুক্ত করে ইজারা দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
রেলগেট থেকে উত্তর দিকে রেললাইন ছিল। সম্প্রতি সেই রেললাইনটি দখলমুক্ত করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সড়ক বানিয়েছে। এর দুইধারের জমি সব বেদখল হয়ে গেছে।
সড়ক ধরে উপজেলার সাগুয়ানঘুন্টি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, লোহার লাল রঙের গুমটিঘরের কাঠামো এখানো দাঁড়িয়ে আছে। সওদাগর নামের এক যুবক বলেন, আসলে এই গ্রামের নাম ছিল সাগুয়ান। ব্রিটিশ আমল থেকে এই গুমটিঘরের কারণে গ্রামের নাম পড়েছে সাগুয়ানঘুন্টি।
এই রেলপথে ট্রেনে যাতায়াত করা নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। ৮৫ বছরের এই প্রবীণ এখন এই গ্রামেই থাকেন। তিনি বলেন, ‘হামার বাড়ি ছিল নবাবগঞ্জের চরে। ওখান থেকে ট্রেনে কাঁচামাল লিয়্যা, রহনপুর গ্যাছি, নাচোল গ্যাছি, আমনুরা গিয়ে বদলি হয়্যা রাজশাহী গ্যাছি। রাজশাহীতে মামলা–মুকদ্দমার কাজে। তখন রেলের খালাসিরা এই গুমটিঘরে গাঁইট্যা মাইট্যা লিয়্যা থাইকতক।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান নুরুল ইসলাম।