প্রাণহানি বেড়েছে দেড় গুণ 

চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছরই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে।

বরিশাল বিভাগের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিবছরই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বিভাগে দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত চার বছরে এই বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে যানবাহন যেমন বেড়েছে, গত ছয় মাসে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিও বেড়েছে অনেক।

দেশে সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) প্রকাশিত চার বছরের সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। ৮ জানুয়ারি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। নিসচার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮২টি। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৯৮ জন, আর আহত হয়েছেন ৮৮৫ জন। ২০২১ সালে বরিশাল বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৩৩৫টি। এতে নিহত হন ২৯৪ জন এবং আহত হন ৭৬৯ জন। চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছরই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। সদ্য সমাপ্ত বছরে তা দেড় গুণ বেড়েছে।

নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক–মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বাড়ানো, মহাসড়কের নির্মাণত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহনের একসঙ্গে চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট এবং অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়া এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।

পদ্মা সেতুর সুফল ম্লান

বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কমেছে যাতায়াতের সময় ও পথের দূরত্ব। কিন্তু অপ্রশস্ত মহাসড়কের কারণে সেতুর পূর্ণ সুফল মিলছে না।

ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটাসহ দক্ষিণের ছয় জেলার মহাসড়কে গাড়ি চলাচল আগের তুলনায় কয়েক গুণ বাড়লেও সে অনুযায়ী সড়ক প্রশস্ত হয়নি। ঢাকা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সুপ্রশস্ত (২টি সার্ভিস লেনসহ ৬ লেন) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা) পর বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত প্রায় ২০৫ কিলোমিটার মহাসড়কের প্রশস্ততা ২৪ ফুটই রয়ে গেছে।

ভাঙ্গা-কুয়াকাটা মহাসড়কটি প্রশস্ত করতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক প্রকল্প’ (এক্সপ্রেসওয়ে) নামে একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়। কিন্তু সে প্রকল্পে এখনো জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। প্রকল্প প্রস্তাবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এই এক্সপ্রেসওয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছিল। তবে এ পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি সড়ক ও সেতু বিভাগ।

গত বছর জুনের শেষ ভাগ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বরিশাল থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় এক থেকে ছয়জন পর্যন্ত যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনের চালক ও সহকারীর প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বাড়ছে।

পদ্মা সেতু চালুর পর এখন বরিশাল থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। বরিশাল থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার মহাসড়কটি ২৪ ফুট প্রশস্ত। আবার অনেক স্থানেই মহাসড়কটির অবস্থা খুবই নাজুক।

বরিশাল বিভাগে ২০২২ সালে সবচেয়ে বড় সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে ওই বছরের ২৯ মে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার সানুহার এলাকায়। একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ১১ যাত্রীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া একই মহাসড়কের বাকেরগঞ্জ এলাকায় বিআরটিসি বাসের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ ছয় যাত্রী এবং উজিরপুরের শিকারপুরে বাসের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ছয় যাত্রী নিহত হন ওই বছরের জুলাই মাসে।

সরকারি তথ্যে দুর্ঘটনা কম

সরকারি তথ্যে দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র বলছে, ২০২২ সালে বিভাগের ৬ জেলায় ৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন ২০৫ জন, আর নিহত হয়েছেন ৮৮ জন। দুর্ঘটনা ও নিহতের এই সংখ্যা নিসচার প্রতিবেদনের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

এ বিষয়ে বিআরটিএর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক জিয়াউর রহমান সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের তারতম্যের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বৈধ যানবাহনের দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহে রাখি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অবৈধ যানবাহনের দুর্ঘটনার তথ্যও
সংযুক্ত করে। যে কারণে তথ্যের তারতম্য হবে।আর সরকারি নীতিমালায় নসিমন-করিমন বা থ্রি-হুইলার কোনো যানবাহনই নয়। এর ফলে সেসব পরিবহনে দুর্ঘটনা ঘটলে তা নীতিমালা অনুসারে আমরা গ্রহণ করি না।’