খুনের মামলার আসামি খুন

মোশারেফ মৃধার মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতে স্থানীয়দের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

মাগুরার মহম্মদপুরে মোশারেফ হোসেন মৃধা (৫৫) নামের এক কৃষকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত সোমবার রাত ১১টার দিকে উপজেলার বালিদিয়া গ্রামের একটি রাস্তার পাশে মরদেহটি পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্বজনেরা। নিহত ওই ব্যক্তি বালিদিয়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলাম মৃধার ছেলে।

মোশারেফ নিজেও একই গ্রামের আবু সাঈদ মোল্লা নামে এক সাবেক পুলিশ সদস্যকে  খুনের মামলার আসামি ছিলেন। মোশারেফ খুন হওয়ার পরের দিনই ছিল ওই হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের দিন। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন পুলিশের সাবেক ওই সদস্য। আদালত সূত্রে জানা গেছে, আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবু সাঈদ হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের দিন পিছিয়ে চলতি মাসের ২৪ তারিখে করা হয়েছে।

নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার ছিল আবু সাঈদ মোল্লা নিহতের মামলার অভিযোগ গঠনের দিন। ওই মামলায় এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে ১৩ নম্বরে নাম ছিলেন মোশারেফ। একই মামলায় ১ নম্বর আসামি বালিদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান ওরফে মিনা। মঙ্গলবার ওই মামলায় তাঁদের মাগুরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হওয়ার কথা ছিল।

স্বজনেরা জানান, গত সোমবার সন্ধ্যায় বালিদিয়া বাজারে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এই মামলার বিষয়ে চেয়ারম্যান মফিজুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন মোশারেফ মৃধা, তাঁর ছোট ভাই ফজর মৃধাসহ কয়েকজন আসামি। রাত ১০টার দিকে আলোচনা শেষে মোশারেফ আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান। এর আধা ঘণ্টা পরই বালিদিয়া গ্রামের শেখ পাড়া ও মৃধা পাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় রাস্তার পাশে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়।

ফজর মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি বাজারে আওয়ামী লীগের কার্যালয়েই ছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে আমার ছোট মেয়ে মোবাইলে আমার ভাইয়ের লাশ পাওয়ার খবর দেয়। আমরা তিন ভাই সাঈদ মোল্লার খুনের আসামি। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি মামলা আপোষ করতে। কারণ, আমরা কেউই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, কিন্তু বরাবরই মামলার বাদীপক্ষের লোকজন আমাদের বলেছে, খুনের বদলা খুন। এ কারণে আমাদের ধারণা, সাঈদ মোল্লার ভাই বা তাঁদের লোকজন আমার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।’

এ অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন নিহত আবু সাঈদ মোল্লার ভাই ও তাঁর হত্যা মামলার বাদী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট ওহিদুর রহমান। প্রথম আলোকে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘যিনি খুন হয়েছেন, তাঁরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। নানাভাবে খুনের মামলা আপোষ করার জন্য তাঁরা চাপ দিয়ে আসছিলেন। তবে আমরা আপোষ করিনি। গতকাল যখন ঘটনা ঘটে, তখন আমি মাগুরা শহরে ছিলাম। আমি বা আমাদের কোনো লোকই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। আমরা দলে ছোট। এমনিতেই থাকি চাপে। আমাদের ধারণা, আমরা আপোষ না করাতে তাঁরা নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের ওপর দায় চাপাতে চাইছে, যাতে আমরা তাঁদের সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য হই।’

স্থানীয় ব্যক্তি, পুলিশ ও বিবাদমান পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বলিদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান এবং বালিদিয়া গ্রামের ইউনুস শিকদারের নেতৃত্বে দুটি দলকেন্দ্রীক গ্রামবাসীর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘাত, সংর্ঘষের ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি রাত আটটার দিকে পাশের গ্রাম বড়রিয়ায় অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবু সাইদ মোল্লা। এ সময় বাধা দিতে গেলে তাঁর ভাই ওহিদুর রহমানসহ কয়েকজন আহত হন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাত ১০টার দিকে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে আনলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বালিদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ড (আবু সাঈদ মোল্লা) ঘটেছিল ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে। যাঁরা ঘটিয়েছিলেন তাঁরা প্রকাশ্যেই হত্যার কথা স্বীকার করছেন। অথচ শুধু দলাদলির কারণে আমিসহ গ্রামের অনেক নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। আমরা বাদীপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, নিরাপরাধ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দিতে। এরই মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল। আমরা এলাকায় শান্তি চাই।’

মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অসিত কুমার রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার রহস্য এখনো উদ্‌ঘাটন করা যায়নি। নিহত ব্যক্তির শরীরে একাধিক ধারলো অস্ত্রের আঘাত দেখা গেছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আর এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।