সারি সারি নার্সারিতে দিনবদল

চারা কিনতে আসছেন দূরদূরান্তের ক্রেতা। অর্থনৈতিক মুক্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে খুশি গ্রামবাসী।

রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল নার্সারি। সেখানে অনেক চারার সমারোহ। ছবিটি সম্প্রতি গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকা থেকে তোলাপ্রথম আলো

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা থেকে একটি সড়ক সোজা চলে গেছে ‘উজান-ভাটির’ জেলা কিশোরগঞ্জের দিকে। সড়কটি ধরে প্রায় ১১ কিলোমিটার সামনে এগোলে শ্রীপুর উপজেলার ছোট্ট গ্রাম মালিপাড়া। সড়কঘেঁষা গ্রামটিতে গেলেই নজর কাড়ে সবুজের সমারোহ। সারি বাঁধা নার্সারিগুলোতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছের চারা। সড়কের পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য।

রাজধানী ঢাকা লাগোয়া গাজীপুরে নার্সারি ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দিন দিন। বিশেষ করে জেলার শ্রীপুর ও কাপাসিয়া উপজেলায় ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নার্সারি। এতে শোভা পাচ্ছে ফুল, ফল, সবজি, কাঠ, শোভাবর্ধন বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য চারা। এসব নার্সারিতে কর্মসংস্থান হয়েছে চারটি গ্রামের অন্তত ৩০০ শ্রমিকের। পাশাপাশি নার্সারিগুলোর মালিকেরাও হয়েছেন আর্থিকভাবে সাবলম্বী। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও যোগ হয়েছে নতুন অনুষঙ্গ।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা থেকে কিশোরগঞ্জগামী সড়কের রাজাবাড়ি কালভার্টের পর শ্রীপুরের মালিপাড়া গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে নার্সারির বাগান। এখান থেকে কাপাসিয়ার ‘মেসার্স মেহেরুন্নেসা ফিলিং স্টেশন’ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক নার্সারি। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন নার্সারি, আশরাফুল নার্সারি, নাছিম নার্সারি, তামান্না নার্সারি, শামিম নার্সারি, বাংলাদেশ কৃষি উদ্যান নার্সারিসহ বিভিন্ন নামের ২০ থেকে ২৫টি নার্সারি।

নার্সারি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান, নার্সারিগুলোতে দেশি-বিদেশি জাতের ফলদ, ফুল বনজ, শোভাবর্ধন ও ঔষধি গাছের চারা, কলমসহ ফুলের চারা উৎপাদিত হয়।

শুরুর কথা

নব্বইয়ের দশকের কথা। আসমা বেগমের স্বামী সুলতান ফরাজী তখন দিনমজুরের কাজ করেন। ঘরে তিন সন্তান। দিনমজুরি থেকে যে আয়, তা দিয়ে সংসার চলত না। একজনের পরামর্শে আসমা বেগম পেঁপে, বেগুন, মরিচের বীজ থেকে ঘরের আঙিনায় চারা উৎপাদন করেন। সেই চারা ভ্যানে করে বাজারে বাজারে বিক্রি করতেন স্বামী সুলতান ফরাজী। এভাবে টানা চার–পাঁচ বছর বিক্রির পর তাঁদের কিছু টাকা মূলধন হয়। এরপর সেই টাকায় ১৯৯৫ সালের দিকে বাড়ির পাশের ছোট্ট জমিতে নার্সারি গড়ে তোলেন। এরপর আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। ধীরে ধীরে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন পাঁচটি নার্সারি।

আসমার ভাষ্যমতে, আঙিনার ছোট্ট নার্সারির লভ্যাংশ দিয়ে ২০০২ সালে রাস্তার পাশে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর ৬ বিঘা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে নার্সারির পরিধি বাড়ান। নাম দেন ‘সুন্দরবন’। সেখান থেকে দিন দিন প্রসার বাড়ে। ব্যবসায় সফলতা আসে। এরপর ধাপে ধাপে মালিপাড়া গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আরও চারটি নার্সারি গড়ে তোলেন আসমা–সুলতান দম্পতি। প্রতিটি নার্সারির গড় আয়তন ছয় বিঘা। ২০১২ সালে তাঁর স্বামী সুলতান ফরাজী মারা যান। এর পর থেকে আসমা ও তাঁর তিন ছেলে নার্সারিগুলো দেখাশোনা করছেন।

নার্সারিটির বিক্রয়কেন্দ্রে (সুন্দরবন-১) বসে কথা হচ্ছিল আসমা বেগমের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের মোট পাঁচটা নার্সারি। নিজেরা সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আমাদের এখানে কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন শ্রমিক। এটা আনন্দের।’

সাবলম্বী হওয়ার একই গল্প শোনা গেল কাপাসিয়ার জামিরার চর গ্রামের বাংলাদেশ কৃষি উদ্যান নার্সারির মালিক রাসেল আহমেদ, সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের আশরাফুল নার্সারির হাডিউল ইসলামসহ বিভিন্ন নার্সারিমালিকদের কাছ থেকে।

খুশি গ্রামবাসী

সড়কসংলগ্ন ভিটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম। স্বামী আদম আলী মোল্যা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কোনো কাজ করতে পারেন না। ছেলেও ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। সংসার খরচের ভার পড়েছে আনোয়ারা বেগমের ওপর। তিনি ‘সুন্দরবন নার্সারি-৩’–এ কাজ করেন। তাঁর দৈনিক হাজিরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। নার্সারি থেকে মাস শেষে যা পান, তা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চলে তাঁর। তিন বছর ধরে কাজ করছেন নার্সারিতে।

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের পক্ষে ইট ভাঙা, রাস্তার কাজ বা মানুষের বাসায় কাজ করাও সম্ভব না। তবে নার্সারিগুলোতে কাজ করা মোটামুটি সহজ। ঝামেলাও কম। কাজ শেষে নগদ টাকা পাচ্ছি। তার চেয়েও বড় কথা, বাড়ির কাছে নার্সারি হওয়ায় কাজ করতে সুবিধা হয়েছে।’

কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মালিক মো. ফারুক মিয়ার সঙ্গে। তিনি একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁর ভাষ্যমতে, যেসব জায়গায় নার্সারিগুলো গড়ে উঠেছে, সেসব জায়গার বেশির ভাগই পড়ে ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। কোথাও কোথাও ধানখেত ছিল। তবে সেখানে আশানুরূপ ফলন হতো না। তবে সেসব জায়গায় এখন নার্সারি হওয়ায় জমির মালিক লাভবান হয়েছেন। পাশাপাশি গ্রামেও কাজ বেড়েছে। এখন যে কেউ চাইলেই নার্সারিগুলোতে কাজ করে সংসার চালাতে পারেন। রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে।

আসছেন দূরদূরান্তের ক্রেতা

জুন থেকে সেপ্টেম্বর, সাধারণত এই চার মাসকে নার্সারির চারা বিক্রির ভরা মৌসুম ধরা হয়। তবে এর বাইরে সারা বছরই নার্সারিগুলোতে কমবেশি ক্রেতা থাকে। স্থানীয় ক্রেতা ছাড়াও চারা সংগ্রহ করতে নরসিংদী, ঢাকা, সাভার, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী, কালীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু লোকজন চারা কিনতে আসেন বলে জানান নার্সারিমালিকেরা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কাপাসিয়া–শ্রীপুর নার্সারি মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও সুন্দরবন নার্সারির পরিচালক কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কাপাসিয়া ও শ্রীপুরে যেসব নার্সারি গড়ে উঠেছে, তার ৮০ ভাগ মালিকই স্থানীয় ব্যক্তি। সবাই দেখাদেখি বা অন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নার্সারি করেছেন। মালিপাড়া গ্রাম থেকে কাপাসিয়ার জামিরার চর পর্যন্ত পাঁচ–ছয় কিলোমিটারে অন্তত অর্ধশতাধিক নার্সারি আছে। এসব নার্সারিতে কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।