এবার ‘ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট’ অ্যাপের নামে প্রতারণা

রাজশাহীতে ইএস এগ্রিমেন্ট অ্যাপ প্রতারণা মামলার আসামি (ওপরে) বাঁ থেকে ওয়াহেদুজ্জামান, ফাতেমা তুজ জহুরা ও মোতালেব হোসেন ভুইয়া। নিচে বাঁ থেকে ফারুক হোসাইন ও মিঠুন মণ্ডলছবি : সংগৃহীত

‘ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট’ অ্যাপে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় গত বুধবার একজন ভুক্তভোগী বাদী হয়ে নগরের রাজপাড়া থানায় মামলা করেছেন। শনিবার বিনিয়োগকারীরা একটি বৈঠক করে রাজশাহীর ৫৮ জনের একটি তালিকা করেছিলেন। তাঁদের অনুমান, সারা দেশ থেকে তারা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা ও ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন নিষিদ্ধ। এর আগে এমটিএফই (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ), ই-মুভি প্ল্যানসহ কয়েকটি বিদেশি অ্যাপ দেশে গ্রাহক তৈরি করে এভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের যে ৫৮ জন ভুক্তভোগীর তালিকা করা হয়েছে, তাঁরা ১ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন।

ভুক্তভোগীরা বলেন, ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের গ্রাহকদের বোঝানো হয়, এই অ্যাপে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। বিদেশ থেকে ব্যাংকে রেমিট্যান্স আকারে প্রতি মাসে মুনাফা আসবে। শুরুর দিকে এমনটিই হয়েছে। তা দেখে বিশ্বাস করে একের পর এক বিনিয়োগকারী ঝুঁকেছেন।

তাঁরা আরও বলেন, এই অ্যাপটি চালু হয় ২০১৯ সালে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের পরে আর কাউকে মুনাফা দেওয়া হয়নি। ব্যাংকের সমস্যার কারণে মুনাফা ঢুকছে না বলে কাউকে কাউকে হাতে-হাতে নগদ মুনাফাও দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রাহকেরা আশ্বস্ত হয়েছেন। এভাবে টালবাহানা করে তাঁদের এক বছর থামিয়ে রাখা হয়। কিন্তু অ্যাপ চালু ছিল। এক মাস আগে অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর রাজশাহী নগরের মোস্তাক হোসেন (৪৫) নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।

মোস্তাক বলেন, অনেক পরে তাঁরা ধরতে পারেন, অ্যাপটি যুক্তরাষ্ট্র নয়, অ্যাপের সার্ভার পরিচালনা করা হয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে। তখন আর কিছু করার ছিল না। তাঁরা পরিচিত ভুক্তভোগীরা শনিবার ৫৮ জনের তালিকা করেছিলেন। এখন আরও অনেক মানুষ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। একজন রোববার সকালে সাভার থেকে ফোন করে জানান যে তিনি ৫০ লাখ টাকা খুইয়েছেন। এ রকম ফোন আসছেই।

মোস্তাক আরও বলেন, তিনি ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান নগরের নওদাপাড়া এলাকার মো. ওয়াহেদুজ্জামানের (৩৮) মাধ্যমে ২০২২ সালের জুনে এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত হন। নিজের পাঁচ লাখ ও আত্মীয়স্বজনের পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রথম কিছুদিন মুনাফা পেয়েছিলেন। যেভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসে, সেভাবেই মুনাফা আসে। ফলে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় ছিল না। ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেই প্রতি মাসে ১১ হাজার ২০০ টাকা করে মুনাফা আসবে—এই আশায় সবাই বিনিয়োগ করেছেন।

গত শনিবারের বৈঠকে ছিলেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক রেজাউল করিম। তিনি ৯ লাখ টাকা খুইয়েছেন। তিনি বলেন, রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকার তাজুল নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি এই অ্যাপে যুক্ত হয়েছিলেন। সব টাকা তাঁর নিজের না। চার-পাঁচজন মিলে দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের নভেম্বরের পর থেকে আর কাউকে মুনাফা দেওয়া হয়নি। তিনি মাত্র তিন মাস মুনাফা পেয়েছিলেন। ওই সময় থেকে তাঁদের বোঝানো হতো, ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’ বাজারে লঞ্চ করলেই মুনাফা পাবেন। এসব বলে তাঁদের টানা এক বছর থামিয়ে রাখা হয়েছে। এক মাস ধরে অ্যাপস বন্ধ হয়ে গেছে। মামলা করার খবর শুনে সবাই মিলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাঁর জন্য শনিবার বৈঠকে গিয়েছিলেন।

রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকার ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি আগে ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন । এখন একটি দোকান চালান। তিনি বলেন, ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফার কথা শুনে তিনি তাঁর জমানো ২৫ লাখ টাকা এই অ্যাপে বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রথম ছয়-সাত মাস তিনি তাঁদের কথামতো মুনাফা পেয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল ব্যাংকের মাধ্যমে, হাতে হাতে, বিকাশে বা যেকোনো মাধ্যমে টাকা নিতে পারবেন। তিনি হাতে হাতে নিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা ব্যাংক থেকে তুলে তাঁকে নগদ টাকা দিয়েছিলেন।

মামলার আসামিরা হলেন ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান মো. ওয়াহেদুজ্জামান (৩৮), তাঁর স্ত্রী ও বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ফাতেমা তুজ জহুরা (৩২), কান্ট্রি লিডার লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের মোতালেব হোসেন ভূঁইয়া (৩৫), মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারুক হোসাইন (৩৯) ও রাজশাহী জেলা এজেন্ট নগরের বোয়ালিয়াপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মিঠুন মণ্ডল (৩৬)।

ওয়াহেদুজ্জামানের ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা তুজ জহুরার ফোন নম্বরটি খোলা আছে। রোববার বিকেলে ফোন করা হলে তিনি একটু সময় নিয়ে বলেন, এটা রং নম্বর। মোতালেব হোসেন ভূঁইয়ার ফোনটি বন্ধ। তবে ফারুক হোসাইনের নম্বরে ফোন করা হলে না ধরে কেটে দেন। মিঠুন মণ্ডলের ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল হক বলেন, মামলায় এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। তবে তাঁরা চেষ্টা করছেন। আসামিদের বিষয়ে কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।