থাইল্যান্ডের কেঁচো থেকে শুরু, বিষমুক্ত কৃষিতে সফল উদ্যোক্তা মামুনুর
থাইল্যান্ড থেকে কেঁচো এনে জৈব সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন শুরু করেন মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি তিনি ট্রাইক্রো কম্পোস্ট, মাশরুম চাষ, কেঁচো বিক্রি এবং আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করেন। প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকার জৈব সার বিক্রি করেন তিনি। এলাকায় তাঁর পরিচয় সফল কৃষক ও উদ্যোক্তা হিসেবে। তাঁর এই উদ্যোগ অন্য কৃষকদের মধ্যেও জৈব সারের চর্চা বাড়িয়েছে।
মামুনুর রশিদের বাড়ি রংপুরের কাউনিয়ার উপজেলার টেপা মধুপুর ইউনিয়নের নিজদর্পা গ্রামে। এইচএসসি পাসের পর তাঁর আর লেখাপড়া হয়নি। ২০১০ সালে বিয়ে করার পর সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে আসে। মামুনুর পৈতৃক জমি দেখাশোনার মাধ্যমে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচিত হন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণের পর ২০১১ সালে কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে ৪০০টি লুমব্রিকাস রুবেলা জাতের কেঁচো এনে জৈব সারের উৎপাদন শুরু করেন।
প্রথম দিকে মামুনুর নিজ জমিতে বোরো ও আমন ধানের বীজ উৎপাদনের জন্য নিজের তৈরি সার ব্যবহার করেন। ২০১৩ সালে এলাকার অন্যান্য জমিতে ধানের শিষ সাদা হয়ে নষ্ট হলেও মামুনুরের দুই একর জমিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ, তিনি জৈব সার ব্যবহার করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মামুনুর বলেন, তখন স্থানীয় কৃষকেরা তাঁর কাছে জানতে চান, কী সার ব্যবহার করেছেন। মামুনুর তাঁর তৈরি করা জৈব সারের কথা বলেন। স্থানীয় কৃষকেরাও তাঁর কাছ থেকে জৈব সার নিয়ে ফসলি জমিতে ব্যবহার করেন। মামুনুরের তৈরি সারে আস্থা পেয়ে স্থানীয় কৃষকেরা এর নাম দেন ‘ম্যাজিক’ সার।
২০১৪ সালে চাহিদা বেড়ে গেলে মামুনুর জৈব সারের উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। ৬টি থেকে ৪০টি সিমেন্টের রিং স্থাপন করা হয় এবং ২০টি হাউস নির্মাণ করা হয়। প্রতি মাসে পাঁচ–ছয় টন সার উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি জৈব সার বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। শ্রমিক দুজন এবং গোবর ব্যবহারের খরচ মাসে ৫০ হাজার টাকা, বাকি টাকা তাঁর লাভ।
২০১৫ সালে ভার্মি কম্পোস্টের পাশাপাশি ট্রাইক্রো কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেন মামুনুর। এটি কেবল সার নয়, ফসলের জন্য বালাইনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইন জানান, ট্রাইক্রো লিচেট ছত্রাক প্রতিরোধী ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। প্রতি লিটার ৬০০ টাকায় মাসে ১০ লিটার বিক্রি করেন মামুনুর।
ছেলে মুনতাসির বিল্লাহ সাবিদের নামে মামুনুর তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেছেন ‘সাবিদ অ্যাগ্রো’। তিনি জানান, ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির ট্রাইক্রো কম্পোস্ট জৈব সার রাসায়নিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এতে ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক, নাইট্রোজেনসহ ১৫টি উপাদান নির্ধারিত মানে পাওয়া গেছে। জৈব সার ব্যবহারে কৃষকের রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের খরচ কমেছে।
কেঁচো বিক্রি ও মাশরুম চাষও মামুনুরের ব্যবসার অংশ। তিনি জানান, একটি রিংয়ে ৫০০ গ্রাম কেঁচো দিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ দিনে তা তিন গুণ বৃদ্ধি পায়। প্রতি মাসে ১০ কেজি কেঁচো বিক্রি করেন, যা এ পর্যন্ত ছয় থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার অন্তত ১০ জন কৃষকও তাঁর কাছ থেকে কেঁচো নিয়ে জৈব সার উৎপাদন করছেন।
মামুনুর আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ধান চাষে লোগো ও পাচিং–পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বাড়ির উঠানে বিষমুক্ত সবজি ও আদা চাষ শুরু করেছেন। সম্প্রতি ঢাকার সাভারের মাশরুম গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪৫ ফিট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফিট প্রস্থের ঘরে ৩০০ স্পন প্যাকেজ দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করেছেন। বর্তমানে তাঁর স্পন সংখ্যা ৫০০ প্যাকেট।
চায়না-৩ জাতের লিচু ও রোজেলা চাষের পাশাপাশি তিনি মাশরুম ও অন্যান্য সবজি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন। পাকা বাড়ি দেখিয়ে কৃষিতে ১৫ বছরের আয়–ব্যয়ের হিসাব দিলেন মামুনুর রশিদ। তিন ভাইয়ের মধ্যে তাঁর বড় ভাই মাহাবুবুর রহমান সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট। ছোট ভাই মোস্তায়িন বিল্লাহ ঢাকায় ব্যবসা করেন। মামুনুর বললেন, ‘বাড়িটা করছি, খরচ ৩০ লাখ টাকা পার হয়েছে। লেখাপড়া করাচ্ছি বাচ্চাদের। ভালো আছি।’
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার বলেন, মামুনুর রশিদ একজন তরুণ উদ্যোক্তা। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের মাধ্যমে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি অনেকের কাছে অনুকরণীয়।