নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়: ছুটির মধ্যে ভাঙা হলো ভাস্কর্য ‘অঞ্জলি লহ মোর’
ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ নামে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখর। প্রকল্পের মূল নকশায় না থাকলেও সাবেক উপাচার্যের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে বর্তমান প্রশাসন। নতুন প্রশাসনের নির্দেশে ছুটির মধ্যে ভাস্কর্যটির ভাঙার কাজ শুরু হয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হলে ভাঙার কাজ বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।
সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দায়িত্বে থাকার সময় প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ভবনের সামনের পুকুরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নির্মাণ করা হয় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য। এটি নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর মনিন্দ্র পাল।
মনিন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে অক্টোবরে শেষ করা হয়। ভাস্কর্য নির্মাণে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি হলেও তিনি ৮ লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকা দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ভাস্কর্যটি ভাঙার খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তিনি বলেন, কবি নজরুলের ‘অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে’ গানকে ভিত্তি করে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণের সময় সবাই প্রশংসা করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভাস্কর্যটি আমাদের মূল নকশায় ছিল না। সাবেক উপাচার্যের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই ভাস্কর্যটি করা হয়েছিল। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর এটি ভাঙার জন্য ছাত্রদের পক্ষ থেকে চাপ ছিল।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি চলাকালে প্রশাসনের নির্দেশে গতকাল ভাস্কর্যটি ভাঙতে শুরু করেন শ্রমিকেরা। বিষয়টি জানাজানির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রতিবাদ জানান। অভিনয়শিল্পী মুনমুন আহমেদ ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘কেউ কি তাঁদের থামাতে পারবেন? ভেঙে ফেলা হচ্ছে “অঞ্জলি লহ মোর” নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ম্যুরাল, যেটি আমার হাতের ছবি থেকে করা হয়েছিল। এটি ভাস্কর্যবিদ মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক যে এই মুহূর্তে সেটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানজিল হোসেন ফেসবুকে লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ভাস্কর্যটি বিনা আলোচনায় ও ছুটি চলাকালে গোপনে ভেঙে ফেলার ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এই নান্দনিক স্থাপনাটি ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের অনুপ্রেরণায় নির্মিত, যা তাঁর সাহিত্য ও সংগীতভাবনার একটি চিত্ররূপ ছিল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিল্প, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার প্রতীক হিসেবে যে ভাস্কর্যটি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, তাকে এভাবে গোপনে ভেঙে ফেলা শুধু প্রশাসনিক অবিবেচনার নয়; বরং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকটকেই প্রকাশ করে।’
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহের অন্যতম সমন্বয়ক জেনাস ভৌমিক লেখেন, ‘এই পুকুরে সাবেক ভিসি মোহিত উল আলম স্যারের বানানো একটা ভাসমান ঘর ছিল। কেউ বলত সিন্ধু সরোবর, কেউ বলত প্রমোদতরি, কোনো অফিশিয়াল নাম ছিল না সম্ভবত। সৌমিত্র শেখর স্যার এসে সেটা ভেঙে দিলেন। একদল শিক্ষক-কর্মকর্তা ভাঙচুরে ভালোই ফুয়েল দিয়েছিলেন। তারপর সৌমিত্র শেখর স্যার এসে পুকুরে বানান “অঞ্জলি লহ মোর”। এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না, অর্থের অপচয়। তবে যেহেতু জনগণের লাখ লাখ টাকা খরচ করে নজরুলের কবিতাকে থিম করে বানানো হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমী স্থাপত্য হিসেবে এটি থাকতে পারত। কিন্তু আবারও একদল শিক্ষক-কর্মকর্তার ফুয়েল আর বর্তমান ভিসি জাহাঙ্গীর স্যারের প্রায়োরিটি লিস্টে এটাও ভাঙা পড়ল। শিক্ষার্থীদের কোনো পক্ষের প্ররোচনা থাকলেও প্রশাসন জানাতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের কোনো জবাবদিহিই তো নেই! প্রতিবার তাদের এই খামখেয়ালি ভাঙা ও গড়ার খরচ দিচ্ছে জনগণ।’
প্রতিবাদের মুখে ভাস্কর্য ভাঙা বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। কিন্তু অধিকাংশই ভেঙে ফেলা হয়েছে। উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম ছুটিতে থাকায় উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন কোষাধ্যক্ষ জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় বিগত সময়ে একক সিদ্ধান্তে ভাস্কর্যটি করা হয়েছিল; কিন্তু প্রকল্পের পুরো কাজ করা হয়নি। পটপরিবর্তনের পর অনেক জায়গা থেকে এটি ভাঙার প্রস্তাব আসে। কেউ কেউ ভাঙারও চেষ্টা করেন। স্থাপনা মজবুত হওয়ায় ভাঙতে পারেনি। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডিন ও সবাইকে নিয়ে সেটি ভাঙার ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিক একটা সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘আসলে ভাস্কর্যটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। এটি ভাঙার সিদ্ধান্ত ছিল আগেই। কিন্তু বন্ধের মধ্যে কেন ভাঙা শুরু হলো, আমরা জানি না। আমরা ইতিমধ্যে জুম মিটিং করে ভাস্কর্যটি ভাঙা বন্ধ করে দিয়েছি। এটি যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় রেখে কীভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা যায়, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’