লিবিয়ায় স্বামীর মৃত্যু, দেশে ঋণের বোঝা ও ছোট ছেলে নিয়ে দিশাহারা মাকসুদা

ছোট্ট জোনায়েদকে বুকে জড়িয়ে বিলাপ করছেন লিবিয়ায় স্বামী হারানো মাকসুদা। শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল কেরাবো এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বছর দুয়েক আগে সাহাব উদ্দিন (৩৫) যখন আবারও লিবিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন, তখন জোনায়েদ দেড় বছরের শিশু। সাহাব উদ্দিনের স্বপ্ন ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষে লিবিয়া আবার শান্ত হবে। ভিনদেশ থেকে তাঁর পাঠানো আয়ে সুদিন ফিরবে পরিবারে। খেয়েপরে মানুষ হবে একমাত্র ছেলে জোনায়েদ।

সাহাব উদ্দিনের সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল। ভূমধ্যসাগরপারের দেশটিতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় মারা যাওয়া ছয় বাংলাদেশির মধ্যে সাহাব উদ্দিনও আছেন। আর এতে সাজানো সংসার ভেঙে লন্ডভন্ড হয়েছে গৃহবধূ মাকসুদা বেগমের (২১)। দূরদেশে স্বামীর মৃত্যু, স্বামী বিদেশ যাওয়ার সময় বাড়ি বন্ধক রেখে নেওয়া ঋণ ও সাড়ে তিন বছরের ছেলে জোনায়েদকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছেন মাকসুদা। এখন তিনি দিশাহারা।

সাহাব উদ্দিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল কেরাবো গ্রামে। গ্রামের মৃত কবির মিয়ার বড় ছেলে সাহাব উদ্দিন। তিনি সহকর্মীদের কাছে পরিচিত সিহাব নামে। আজ শুক্রবার সকালে সাহাব উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে লোকজনের ভিড় দেখা যায়। তাঁদের ভিড়ে অন্ধকার টিনের ঘরে ছেলে জোনায়েদকে বুকে জড়িয়ে মাকসুদা বিলাপ করছিলেন আর বলছিলেন তাঁর স্বপ্নভঙ্গের কথা, ছেলের এতিম হওয়ার কথা।

মাকসুদার পাশে থাকা সাহাব উদ্দিনের ফুফু সুরবান বলেন, ‘মাইয়াডা পাগল হইয়া গেছে। স্বামী মরল, লাশটাও দেখল না। এর মধ্যে বাড়িটা বন্ধক, ঋণের সুদ। বাপটা নিজেই চলতে পারে না। একটা ভাইও নাই। লিবিয়ার বন্যা মাইয়াডারে দুঃখের সাগরে ভাসাই দিল।’

সুরবান, মাকসুদা আর বাড়িতে আসা প্রতিবেশীরা যখন শোকে বিহ্বল, তখনো নির্বিকার জোনায়েদ। নিজের মতো হাসছে, খেলছে। কখনোবা কোলে বসে মায়ের কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলের এমন আচরণে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মাকসুদা। বিলাপ করতে করতে মাকসুদা বলেন, ‘ও খোদা, আমার মাসুম পোলাডা কোন অপরাধ করল, ও কেন পিতৃহারা হইল, ও কার লগে ফোনে কথা কইব, কার কাছে লিচু চাইব, নতুন জামা চাইব! কারে বলব, বাবা, তুমি দেশে আসো! ও তো জানে না, ওর বাবা আর কোনো দিন দেশে আইব না, আর ফোন কইরা বাবা বইলা ডাকব না।’

মাকসুদার বিলাপ শেষ না হতেই জোনায়েদ দুই হাতে মায়ের দুই গাল চেপে ধরে। আদুরে কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মা, বাবারে কইয়ো আওনের সময় লিচু আনতে।’ ছেলের এমন আবদারে বুক চাপড়ে হাউমাউ করে চিৎকার করে ওঠেন মাকসুদা।

সাহাব উদ্দিনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে অভাবের তাড়নায় ১০ বছর আগে মিসর গিয়েছিলেন সাহাব উদ্দিন। সেখান থেকে অবৈধ পথে লিবিয়া যান। লিবিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কোনো আয়-উপার্জনের সুযোগ না পেয়ে ছয় বছরের প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফেরেন তিনি। ২০১৮ সালে পাশের গ্রামে বিয়ে করেন। সেই সংসারে জোনায়েদের জন্ম হয়। ছোট্ট জোনায়েদ আর স্ত্রী মাকসুদাকে রেখে আবারও লিবিয়ায় পাড়ি জমান সাহাব উদ্দিন।

সুরবান বলেন, স্থানীয় দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যেতে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়। বিদেশ যাওয়ার কিছু টাকা চড়া সুদে আর বাকি টাকা জোগাড় হয়েছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দেড় শতাংশের বাড়িটি বন্ধক রেখে। সাহাব উদ্দিনের আশা ছিল, লিবিয়ায় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হলে ভালো আয়–উপার্জন হবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হলো না। বিদেশ থেকে মুঠোফোনে সাহাব জানিয়েছিলেন, লিবিয়ার দারনা শহরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পেয়েছেন। কাজ মিললেও ঠিকঠাক মজুরি মেলে না। দেশে রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা নিয়ে তাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন সাহাব উদ্দিন।

সুরবানের আলাপের মধ্যেই কথা বলেন মাকসুদা। পৃথিবীর সব ক্লান্তি যেন তাঁর কণ্ঠে। বললেন, ‘রবিবার সন্ধ্যায় স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়। কইলো আসমানডা কালা হইয়া আইছে। কোনো বাতাস নাই। সবকিছু স্তব্ধ হইয়া রইছে। অনেক গরম। বৃষ্টি হইব মনে হয়। তারপর আর কথা হয় নাই। কোনো খোঁজ নাই। পরে টিভিতে কইল, উনি মারা গেছেন। কিন্তু আমরা লাশ দেখি নাই। লাশের ছবি দেখি নাই। ওনার লগের লোকেরা একটা ভিডিও কইরা পাঠাইছে।’

আরও পড়ুন

মাকসুদা তাঁর মুঠোফোন এগিয়ে ধরে সেই ভিডিও দেখান। ভিডিওতে তিনতলা একটি পাকা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের চারপাশে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের চিহ্ন দেখা যায়। পুরুষ কণ্ঠে সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে আঙুলের ইশারায় বলা হচ্ছে, ‘এটা একটা তিনতলা বাড়ি ছিল। বাড়িটির দোতলায় সিহাব (সাহাব উদ্দিন) আর সুজন থাকত। এই দোতলার কিছুই আর এখন নাই। তিনতলায় থাকত মামুন। সেই তিনতলারও এখন আর কোনো চিহ্ন নাই।’

মুঠোফোনে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সাহাব উদ্দিনের বাসভবন দেখতে দেখতেই মাকসুদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। পাশে খেলায় ব্যস্ত ছেলের দিকে নিষ্পলক শুধু তাকিয়ে ছিলেন।