থামানো যাচ্ছে না তামাক চাষ

রংপুরের তারাগঞ্জ দিগন্তজোড়া তামাকখেত। কাজে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। গতকাল উপজেলার দোলাপাড়া মাঠেছবি: প্রথম আলো

রংপুরের জেলার সর্বোচ্চ তামাক চাষ হয়েছে তারাগঞ্জ উপজেলায়। পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি জেনেও কোনোভাবেই থামছে না এ উপজেলায় তামাক চাষের আগ্রাসন। স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, উৎপাদনের আগে কোম্পানির তামাকের দর নির্ধারণ, বিক্রয়ের নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ দানের কারণে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষকেরা।

গত বছর আলুর সর্বোচ্চ দাম পেয়েও এবার ১০ শতকে আলু চাষ ও এক একরে তামাকের চাষ করেছেন ইকরচালী ইউনিয়নের প্রামাণিকপাড়া গ্রামের কৃষক তারাজুল ইসলাম। তারাজুল ইসলাম বলেন, ‘আলু চাষ করতে বহুত টাকা লাগে। কিন্তু তাংকু (তামাক) চাষ ফ্রি, সার, বীজ, কীটনাশ, ঋণ সউগ কোম্পানি দেয়। ওরায় আবার বেশি দামে কিনি নেয়। খরচ নাই, লাভ বেশি ওই জন্যে তাংকু আবাদ করছি।’

তামাক চাষে আমরা মাঠপর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি। কোম্পানির প্রলোভনে বেশি লাভের আশায় কিছু কৃষক তামাক চাষ করছেন। আমাদের লক্ষ্য, তামাক চাষ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।
ঊর্মি তাবাসসুম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, তারাগঞ্জ

ক্ষতিকর জেনেও এবার এক একরে তামাক চাষ করেছেন হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের ছুট মেনানগর গ্রামের ভোলা মিয়া। দোলাপাড়া মাঠে পাঁচজন শ্রমিক নিয়ে খেত থেকে তামাকপাতা তুলছিলেন। কাজটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘তামাকপাতা ভাঙা’ বলে থাকেন লোকে। ভোলা মিয়া বলেন, ‘আলু চাষ করলে ক্যাশ টাকা নাগে। এক কেজি আলুর বীজ ৭০ টাকা আর তামাকের বীজ ফ্রি। দাম বেশি পাবার গেইলে আলু হিমাগারোত থুবার নাগে। কিন্তু তাংকু ভাঙি শুকি বাড়িত যেকোনো জায়গাত ফেলে তুইলে মাসের পর মাস থাকে। দাম বাড়লে ইচ্ছেমতো বেচা যায়। কোম্পানির সার, বীজ, লোন সুবিধা তো আছে। ওই জন্যে তাংকু নাগাছি।’

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে তারাগঞ্জের পাঁচটি ইউনিয়নে ৯৬০ হেক্টরে তামাকের চাষ হয়েছে, যা জেলার অন্য উপজেলাগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, আগের থেকে অনেক তামাক চাষ কমেছে। তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন তাঁরা।

তারাগঞ্জের অন্তত ১০টি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠজুড়ে শুধু তামাকের খেত। শিশু, নারী, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ তামাকের খেতে সেচ, পাতা ভাঙা ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের কৃষক সোনা মিয়া বলেন, ‘বাহে, তামাক চাষোত বাড়ির মাইয়া, ছাওয়া সোবায় কাজ করির পায়। আর তামাক বিক্রি নিয়া কোনো টেনশন থাকে না, নিশ্চিন্তে বেচা যায়। ওই জন্যে হামরা তামাক নাগাই। তামাক হামার অভাব দূর করছে।’

লক্ষ্মীপুর গ্রামের মাঠে তামাকখেতে কাজ করা শ্রমিক সেলিম হোসেন বলেন, ‘তাংকুর খেতে কাজ করলে খাবার রুচি থাকে না। মাথা ঘোরে, বমি আসে। কিন্তু কাজ না করলে খামো কী? ওই জন্যে বাধ্য হয়া তাংকু বাড়িত কাজ করুছি। এইবার হামার এলাকাত সর্বোচ্চ তাংকুর চাষ হইছে।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানব কল্যাণ ঘর সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষি বিভাগ যে পরিমাণ তামাক চাষের রেকর্ড দেখায়, বাস্তবে তার কয়েক গুণ বেশি তামাক চাষ হয় তারাগঞ্জে। এলাকায় তামাকের খেতে শিশুদের ব্যবহার বাড়ছে। যেটা খুবই উদ্বেগজনক। এ ছাড়া চাষি ও শ্রমিকদের নানা ধরনের সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। কৃষি বিভাগ আগে তামাকবিরোধী নানা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখন তেমন কিছু চোখে পড়ে না।

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রতিবছর বাজেটে বড় অঙ্কের কৃষি ভর্তুকি প্রদান করে। তামাকচাষিরা এসব ভর্তুকি থেকে নানা কারণে বঞ্চিত হন। কৃষি বিভাগের উচিত তামাকচাষিদের কৃষি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা।

তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহীন সুলতানা বলেন, তামাকের বহুল ব্যবহারে কারণে হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, বক্ষব্যাধি মতো রোগ হয়। এ ছাড়া অন্যান্য অনেক রোগ ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক।

তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসসুম বলেন, ‘তামাক চাষে আমরা মাঠপর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি। আগের তুলনায় তারাগঞ্জে তামাক চাষ কমেছে। কোম্পানির প্রলোভনে বেশি লাভের আশায় কিছু কৃষক তামাক চাষ করছেন। আমাদের লক্ষ্য, তামাক চাষ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।’