তাসমিনাদের ঘোড়াটি মারা গেল, কাঁদছে বোন হালিমা
নওগাঁর ধামইরহাটের স্কুলছাত্রী হালিমা খাতুনের স্বপ্ন ছিল ঘোড়া ছুটিয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার। বড় বোন তাসমিনা আক্তারের পথ ধরে সেই স্বপ্নযাত্রা শুরু হালিমার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল বুধবার দুপুরে। কারণ, তার ঘোড়াটি মারা গেছে।
বুধবার বেলা একটার দিকে রংপুরের তারাগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে মারা যায় ঘোড়াটি। ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার নিতাই কোরানীপাড়া গ্রামে দুই দিনের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সেখানে যান হালিমা ও তার বাবা ওবায়দুল হক মণ্ডল। সেখানেই ঘোড়াটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
হালিমার বোন তাসমিনার ঘোড়া ছিল না। অন্যের ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামত সে। অন্যকে জিতিয়ে দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরত সে। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ১৭ জুন প্রথম আলোয় ‘এক দুঃখিনী ঘোড়সওয়ারের গল্প’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই বছর ঢাকার একজন দয়ালু ব্যবসায়ী তাসমিনাকে একটি ঘোড়া কিনে দেন। কিন্তু ঘোড়াটি এক চোখে দেখতে পেত না। সেই ঘোড়াটি তার কোনো কাজে আসেনি। পরে অল্প কিছু দামে ওবায়দুল ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন।
তাসমিনার ঘোড়ার দুঃখ দূর করার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একবার দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে ওবায়দুল হক মেয়েকে সুন্দর একটি ঘোড়া কিনে দেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে আঘাত পেয়ে ঘোড়াটি প্রায় অচল হয়ে যায়। মাত্র ৪৯ হাজার টাকায় ওবায়দুল হক ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন। মেয়েটির আবার মন খারাপ হয়। দ্বিতীয়বার তার ঘোড়া কেনার জন্য প্রথম আলো থেকে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু একটি ঘোড়া নিয়ে বেশি দিন দৌড়ানো যায় না। সেই ঘোড়াটিও বিক্রি করে তাসমিনা সম্প্রতি আরেকটি ঘোড়া কিনে। এবার তাকে সহায়তা করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা। এই ঘোড়াটিও এবার মারা গেল।
হালিমার বাবা ওবায়দুল মণ্ডল জানান, গতকাল মঙ্গলবার পিকআপে করে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার চকসুবল গ্রামের বাড়ি থেকে তাঁরা কোরানীপাড়া গ্রামে যান। সেখানে পৌঁছানোর পর হঠাৎ ঘোড়াটি অসুস্থ হয়। এরপর বুধবার বেলা ১১টার দিকে পিকআপে করে পাশের তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে বেলা একটার দিকে ঘোড়াটি মারা যায়।
বেলা দুইটার দিকে তারাগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মারা যাওয়া ঘোড়াটি মাঠে পড়ে আছে। পাশে বসে আছেন ওবায়দুল মণ্ডল। কিছুক্ষণ পর হালিমা সেখানে ছুটে আসে। মৃত ঘোড়াটিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
হালিমা বলল, ‘আমি আমার ঘোড়া চাই। আমার অনেক শখের ঘোড়া ছিল। এই ঘোড়া দিয়ে আমাদের সংসার চলে, এখান থেকেই আমি পড়ালেখা করি। আমি কিসে চড়ব, এখন আমি কীভাবে লেখাপড়া করব?’
হালিমা এখন সংকরপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। কিছুদিন পর নবম শ্রেণিতে উঠবে। অশ্বচালনার প্রতি তার টান ছোটবেলা থেকেই। বড় বোন তাসমিনা আক্তার নীলফামারী, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘোড়াদৌড়ে সুনাম কুড়ানো আরেক সাহসী অশ্বারোহী। এখন ধামইরহাট মহিলা ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। তাঁর পথ ধরে নিজেকেও আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বড় স্বপ্ন হালিমার।
হালিমার বাবা ওবায়দুল মণ্ডল বলেন, ‘বড় মেয়ে তাসমিনার ঘোড়সওয়ার দেখে প্রথম আলো থেকে ঘোড়া কিনে দিয়েছিল। ঘোড়াটা মেয়ে দুইটার খুব প্রিয় ছিল। ঘোড়াটার মারা যাওয়ার কথা শুনে বড় মেয়ে বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে হালিমা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ও আজ খেলায় অংশ নিত। কোনোভাবে তাকে বোঝাতে পারছি না। ঘোড়াটাই ছিল তার সব। আমার ৫ শতক ভিটাজমি ছাড়া কিছু নেই। ওদের কীভাবে ঘোড়া কিনে দেব, সেই সামর্থ্য আমার নেই।’
তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ইসরাতুজ্জাহান ইমা জানান, ঘোড়াটি প্রচণ্ড ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল, অনেক জ্বর ছিল। তিন দিন থেকে ঘোড়াটি অসুস্থ ছিল। তিনি বলেন, ‘ঘোড়াটিকে আমাদের কাছে আনার পর আমরা পর্যবেক্ষণ করি, আমাদের কাছে কোলিক বলে মনে হয়েছে। আমরা দুই ঘণ্টা ধরে চিকিৎসাসেবা দিই। কিন্তু ঘোড়াটি মারা যায়।’