মেহেন্দীগঞ্জে অভিযানের সময় জেলের মৃত্যু, মৎস্য বিভাগ ও স্বজনদের পাল্টাপাল্টি দাবি
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার কালাবদর নদীর অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরার বিরুদ্ধে উপজেলা মৎস্য বিভাগ অভিযানে গেলে ট্রলার ও স্পিডবোটের সংঘর্ষে এক জেলে নিহত হয়েছেন। নিহত জেলে মিরাজ ফকির (৩০) মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের মিয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ওই গ্রামের ফখরুল ফকিরের ছেলে। তবে মিরাজের মৃত্যু নিয়ে মৎস্য বিভাগ ও পরিবারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
মৎস্য বিভাগ বলছে, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে অভিযানে গেলে সংঘবদ্ধ জেলেরা তাঁদের স্পিডবোটে হামলা চালাতে গিয়ে ওই জেলে আহত হয়ে মারা যান। তবে নিহত মিরাজের স্বজনদের ভাষ্য, অভিযানের সময় স্পিডবোট ট্রলারের ওপর তুলে দিলে মিরাজ আহত হন এবং এরপর মারা যান। স্থানীয় একটি সূত্রে একই রকম তথ্য জানা গেছে। সূত্রটি বলছে, সংঘবদ্ধ জেলেরা স্পিডবোটের ওপর হামলা চারানোর সময় ট্রলার থেকে আঘাত লেগে ছিটকে নদীতে পড়ে যান জেলে মিরাজ। পরে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তারা খবর পায়, কালাবদর নদীর শ্রীপুর এলাকায় নিষিদ্ধ বাধা জাল ফেলে অবৈধভাবে মাছ ধরছেন একদল জেলে। পরে উপজেলা মৎস্য বিভাগের মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা সুকান্ত কুমার রায়ের নেতৃত্বে মৎস্য বিভাগের আট সদস্যের একটি দল স্পিডবোট নিয়ে অভিযানে যায়। অভিযানকারীরা নদী থেকে অবৈধ বাধা জাল তুলছিলেন। এ সময় ৮ থেকে ১০টি নৌকায় থাকা জেলেরা মৎস্য বিভাগের অভিযানকারী দলের স্পিডবোটে হামলা চালান। এ সময় একটি নৌকা স্পিডবোটের ওপর উঠিয়ে দেয়। তখন ওই নৌকা থেকে জেলে মিরাজ ফকির নদীতে পড়ে যান। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে নদী থেকে উদ্ধার করে বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে সেখানে তিনি মারা যান।
তবে ভিন্ন দাবি নিহত মিরাজ ফকিরের স্বজনদের। জুলহাস গাজী একজন আত্মীয় গতকাল রাতে হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, কালা বদর নদীতে অভিযানের সময় মৎস্য বিভাগের দ্রুতগামী স্পিডবোট জেলেদের নৌকার ওপরে উঠে গেলে জেলে মিরাজ ফকির গুরুতর আহত হন। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাঁকে শের–ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে মারা যান।
অভিযোগের বিষয়ে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা সুকান্ত কুমার রায় আজ মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের অভয়াশ্রমে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা চলছে। আমরা নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে আটজনের একটি দল কালাবদর নদীতে টহল দিচ্ছিলাম। এ সময় বেশ কয়েকটি মাছ ধরা ট্রলার আমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে এসে ধাক্কা দেয়। এতে আমাদের স্পিডবোট ফুটো হয়ে যায় এবং ধাক্কা দেওয়া ট্রলারটি উল্টে যায়। এতে মিরাজ নামে ওই জেলে গুরুতর আহত হন। আহত মিরাজকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে ডুবে যাওয়া ট্রলারটিকেও উদ্ধার করা হয়।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশেই ট্রলারটি আমাদের বহনকারী স্পিডবোটের ওপরে আঘাত করেছিল। ভাগ্যক্রমে আমরা রক্ষা পেয়েছি।’
এ ঘটনাটি শুনেছেন বলে জানিয়েছেন মেহেন্দীগঞ্জের কালীগঞ্জ নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক। তবে বিষয়টি নিয়ে আজ বিকেল পর্যন্ত কোনো পক্ষ অভিযোগ দায়ের করেনি বলে তিনি জানান।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মশিউর রহমান এ প্রসঙ্গে জানান, মৎস্য বিভাগের নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে, গতকাল বিকেলে অভিযান চলছিল। যখন জেলেদের একটি বাধা জাল উঠানো হচ্ছিল, তখন অন্য আরেক দিক থেকে আরেকটি জেলেদের ট্রলার দিয়ে হামলা চালানো হয় অভিযানে যাওয়া স্পিডবোটের ওপর। এ সময় ওই জেলে আহত হওয়ার পর তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর পর তিনি মারা যান। মারা যাওয়া জেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও চাঁদপুরের অংশ মেঘনা ও এর শাখা নদী ঘিরে দেশের সবচেয়ে বড় ইলিশের অভয়াশ্রম। কিন্তু এখানে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে কয়েক হাজার নৌকা ও ট্রলার নিয়ে নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার করা হতো। আওয়ামী লীগের পতনের পর বর্তমানে বিএনপির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এই মাছঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এসব অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। অবৈধভাবে মাছ ধরার বিরুদ্ধে প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযানে নামলে প্রায়ই তাঁদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মেঘনা নদীতে জাটকা সংরক্ষণ অভিযান পরিচালনার সময় জেলেদের হামলার শিকার হয়েছিলেন ভোলা সদর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তাসহ সাতজন। গত বছরের ১৮ অক্টোবর বরিশালের হিজলা উপজেলার মেঘনা নদীতে ইলিশের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে অভিযান চালানোর সময় ইউএনওর স্পিডবোটে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান জেলেরা। এ ঘটনার সময় র্যাবের সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এর আগে ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মেহেন্দীগঞ্জে অভিযান চালাতে গিয়ে সংঘবদ্ধ জেলেররা নৌকা নিয়ে স্পিডবোটের ওপর উঠিয়ে দিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন ও আনসার সদস্য তুহিন মিয়া আহত হয়েছিলেন। এ সময় একজন আনসার সদস্যের সঙ্গে থাকা একটি শর্টগান নদীতে পড়ে খোয়া যায়।
সব ধরনের মাছের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রমের মধ্যে পাঁচটিতে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। ১ মার্চ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাসংলগ্ন আন্ধারমানিক নদীর অভয়াশ্রমটি এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই। এখানে গত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর—দুই মাস নিষেধাজ্ঞা ছিল।