সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের আকর্ষণ শামুক-ঝিনুকের পণ্যে

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণে এসে পর্যটকদের ক্রয় তালিকায় থাকে শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি বাহারি পণ্য। গত শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট। শনিবার ঈদের দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। চার চাকার একটি ভ্যান গাড়িতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি বাহারি পণ্য। আরও আছে মাথার খোঁপা, কানের দুল, হাতের বালা, গলার সেট, আংটি, চুড়ি, মেইকা ঝাড়বাতি, ঝিনুকের ল্যাম্প, ডুলা ঝাড়বাতি, ব্যাগ, দরজা-জানালার নেটসহ কত কিছু।

১০-১২ জন পর্যটক দোকানটি ঘিরে রকমারি পণ্য দেখছেন। কেউ পছন্দের পণ্যটি কিনে হোটেলে ফিরছেন। সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, সিগাল, লাবণী পয়েন্টসহ আশপাশের সড়কে এ রকম শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি রকমারি পণ্য বিক্রির দোকান আছে পাঁচ শতাধিক। রোজার পুরো এক মাস সৈকতে পর্যটক না থাকায় শামুক-ঝিনুকের পণ্যের সব কটি দোকান বন্ধ ছিল। ঈদের ছুটিতে এখন সৈকতে নামছেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক। ফলে এসব দোকানে বিক্রিও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রোববার সকাল থেকেও দোকানগুলোতে পর্যটকের সমাগম ঘটছে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে দোকানে বিক্রি।

সন্ধ্যায় সুগন্ধার সৈকতের একটি দোকান থেকে ৩০ টাকা দরে ১০টি ঝিনুকের মালা কেনেন কুমিল্লার গৃহবধূ নিলুফা ইসলাম। তাঁর স্বামী নজিবুল ইসলাম ৯০০ টাকা দামে কেনেন একটি ঝাড়বাতি। আলাপকালে নজিবুল ইসলাম বলেন, ঝাড়বাতিটি তিনি ঘরের ড্রয়িংরুমে ঝুলিয়ে রাখবেন। বাতির ভেতরে বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগানোর ব্যবস্থাও আছে।

নিলুফা ইসলাম বলেন, ঝিনুকের মালা তিনি কিনেছেন আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী মেয়েদের উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য। কম দামের হলেও স্বজনদের কাছে ঝিনুকের মালার চাহিদা অনেক।

দোকানগুলোয় শামুক ও কড়িতে নাম লেখার ব্যবস্থাও আছে। ইচ্ছে করলে কড়ি বা শামুকে যেকোনো নাম লেখানো যায়। কুমিল্লার কয়েকজন তরুণ কিছু শামুক ও কড়িতে প্রিয়জনের নাম, উক্তি ও স্থানের নাম লিখিয়ে নেন। নাম লেখানো প্রতিটি শামুক ও কড়ির দাম পড়ে ৫০-১৫০ টাকা।

সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, সিগাল, লাবণী পয়েন্টসহ আশপাশের সড়কে এ রকম শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি রকমারি পণ্য বিক্রির দোকান আছে পাঁচ শতাধিক। শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট
ছবি: প্রথম আলো

দোকানগুলোতে শামুকের তৈরি মাথার খোঁপা, কানের দুল, হাতের বালা, গলার সেট বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৩০০ টাকায়। ঝিনুকের পণ্য দিয়ে তৈরি গলার মালা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০০ টাকায়। মুক্তার মালা (ছোট-বড়) ১০০ থেকে ৯০০ টাকা, কানের দুল, হাতের বালা, আংটি, হাতের চুড়ি ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, ঝিনুকের মেইকা ঝাড়বাতি ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা, ঝিনুকের ল্যাম্প ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা, ডুলা ঝাড়বাতি ২০০ থেকে ৭০০ টাকা, ঝরনা বাতি ২০০ থেকে ৭০০ টাকা, শামুক দিয়ে তৈরি রাজমুকুট ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা, ল্যাম্প সেট ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা, শামুকের বালা ১০০ থেকে ২০০ টাকা, শামুকের ভ্যান ৩০ থেকে ৬০ টাকা, শামুকের ব্যাগ ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এ ছাড়া কালো কড়ি শামুক, শঙ্খ শামুক দিয়ে তৈরি ঘর, ফুল, ক্লিপ, মালা, লাল কাঁটা, কালো কাঁটা, ব্যাঙ কাঁটা, চামচ, জালকাটা, শৈবাল, দরজা ও জানালার নেট বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৫০০ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা জানান, কক্সবাজার সৈকতের টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া উপকূলে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে বিপুলসংখ্যক মরা শামুক-ঝিনুক। স্থানীয় ব্যক্তিরা শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। পরে কক্সবাজারের বাহারছড়া, কলাতলী, ঘোনাপাড়া, সৈকতপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ঘরে ঘরে শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি হয় রকমারি পণ্য। আগে সৈকতে ১২০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া গেলেও এখন ৩০ প্রজাতি ভেসে আসছে।

শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি বাহারি পণ্যের দোকান
ছবি: প্রথম আলো

শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ, বেচাকেনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, উৎপাদন এবং পণ্য বিক্রি ও সরবরাহে জড়িত প্রায় দুই লাখ মানুষ। শহরের সবচেয়ে বড় ঝিনুক মার্কেটের অবস্থান সৈকতের লাবণী পয়েন্টে। এখানে শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির দোকান আছে ৫৪টি। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। এই মার্কেটে মেসার্স আফসার স্টোরে মজুত আছে প্রায় ১২ লাখ টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য। শনিবার ঈদের দিন বিক্রি হয়েছে ৪৫ হাজার টাকার পণ্য।

দোকানের ব্যবস্থাপক সাফায়েত হোসেন বলেন, সৈকতে পর্যটক বাড়লে বিক্রি বাড়ে। ঈদের দ্বিতীয় দিন সৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। ফলে বিক্রিও বেশি হয়।

হোটেলমালিকেরা জানান, ঈদের ছুটিসহ ১০ দিনে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসছেন অন্তত আট লাখ পর্যটক। ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজের ৮০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়েছে। আট লাখ পর্যটকের বিপরীতে হোটেল, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার।

১০ দিনে ২০ কোটি টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রি হবে জানিয়ে কক্সবাজার বিচ পার্ক ঝিনুক মার্কেটের ব্যবসায়ী ও সমবায় সমিতির নেতা মোশারফ হোসেন বলেন, শামুক-ঝিনুকের পণ্যের চাহিদা অনেক পর্যটকের। বাড়ি ফেরার পথে কম-বেশি সবাই শামুক-ঝিনুকের পণ্য কিনে নিয়ে যান। অনেকে বিক্রির জন্য বেশি পরিমাণ ক্রয় করেন। কারণ, এখানে কম দামেই পাওয়া যায় রকমারি পণ্য।

কক্সবাজারে ঝিনুক শিল্পের সূচনা করেন আর্ট সেন্টারের মালিক পঞ্চানন বড়ুয়া। ষাটের দশকে তিনি প্রথম কক্সবাজারে শামুক-ঝিনুকের পণ্যের বাজারজাত শুরু করেন। সে সময় পঞ্চানন বড়ুয়া পাকিস্তানের করাচি শহরে মিয়াজি নামের এক ব্যবসায়ীকে কাঁচামাল ও ঝিনুক সরবরাহ করতেন। মিয়াজি করাচিতে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটান। তা দেখে পঞ্চাননও ১৯৬৮ সালে কক্সবাজারে নুর আহমদ ও মীর আহমদ নামের দুজন কারিগর নিয়ে আসেন এবং একটি কারখানা চালু করে শুরু করেন ব্যবসা। কয়েক দশকের মধ্যে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। বর্তমানে শামুক-ঝিনুকের পণ্যের পাঁচ শতাধিক দোকানে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ শত কোটি টাকা।