মৎস্য খাতে সাফল্য
দিনে ৪ কোটি টাকার তাজা মাছ বিক্রি
প্রতিদিন বিকেল থেকে ভোররাতের মধ্যে ১৫০ ট্রাকের বেশি তাজা মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। প্রতি ট্রাকে ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি মাছ থাকে। সে হিসাবে প্রতিদিন চার কোটি টাকার বেশি এই তাজা মাছ বিক্রি হয়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা গ্রামে ঢুকতেই চোখ পড়ে পুকুর আর পুকুর। সেখান থেকে মাছ ধরা হচ্ছে। কিছুটা দূরে গিয়ে তা রাস্তায় দাঁড়ানো পানিভর্তি ছোট-বড় ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এই পারিলা গ্রাম থেকেই প্রতিদিন ৫০ ট্রাকের মতো তাজা মাছ যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে। আর পুরো রাজশাহী জেলা থেকে যায় ১৫০ ট্রাকের বেশি তাজা মাছ। এই মাছের বাজারদর ৪ কোটি টাকার বেশি। আর এর সঙ্গে নিয়োজিত আছেন কয়েক লাখ মানুষ।
রাজশাহী মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৯টি উপজেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭২০টি। ১১টি নদী, ৬৭টি বিল, ১৬০টি খালসহ অসংখ্য জলাভূমিতে মাছ চাষ হয়ে থাকে। প্রতিবছর এই জেলায় মাছ চাষের আওতা বাড়ছে। জেলায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে মাছ চাষ হয়েছিল ৭৫ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন। এরপর প্রতিবছর তা বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২১-২২ বছরে ৮৫ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, এই জেলায় মাছ চাষে সফলতার পেছনে রয়েছে এক গল্প। ২৪ বছর আগে এই জেলা থেকে তাজা মাছ পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ অন্তত ২৫টি জেলায় প্রতিদিন তাজা মাছ পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে রাজশাহীর বাইরের মানুষ ফরমালিনমুক্ত মাছ খেতে পারে। ফলে এ জেলার মাছের চাহিদা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, প্রতিদিন বিকেল থেকে ভোররাতের মধ্যে ১৫০ ট্রাকের বেশি তাজা মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি মাছ থাকে। সে হিসাবে প্রতিদিন চার কোটি টাকার বেশি এই তাজা মাছ বিক্রি হয়। বর্তমানে মাছ চাষসহ এ পেশার সঙ্গে এই জেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ নানাভাবে জড়িয়ে আছেন।
জেলার সবচেয়ে বেশি মাছ চাষ হয় পবা উপজেলায়। পারিলা গ্রামে ৮ নভেম্বর গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে মাছ বহনের জন্য ছোট–বড় ট্রাক প্রস্তুত করা হচ্ছে। গ্রামের নগর পারিলা এলাকায় একটি ট্রাকে পাইপ দিয়ে পানি ভরছিলেন ট্রাকচালক মো. মোয়াজ্জেম ও সহকারী ইয়াকুব আলী। মোয়াজ্জেম বললেন, বিকেলে পুকুর থেকে মাছ তোলা হবে। সেই মাছ নছিমন গাড়িতে করে এই ট্রাকের সামনে আনা হবে। এ জন্য ট্রাকটি পলিথিন, ত্রিপল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এই মাছ নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ট্রাক যাবে ঢাকার নিউমার্কেটের উদ্দেশে।
ট্রাকের সহকারী ইয়াকুব নিয়ে গেলেন নগর পারিলা থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দক্ষিণে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি পুকুরে ৮-১০ জন রুই, কাতলা মাছ ধরছেন। ওই পুকুরের মালিক মোশারফ হোসেন। তিনি মাছ গুনছিলেন। পাতিলে করে মাছ নিয়ে এক কিলোমিটার দূরে পানিভর্তি নছিমন গাড়িতে তুলছিলেন চার-পাঁচজন শ্রমিক।
মোশারফ ১৪ বছর ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মাছ পাঠান। প্রায় ২২ বিঘা জমির ওপর তাঁর পুকুরটি কাটা হয়েছে । তিনি বলেন, একসময় রাজশাহীতেই মাছ বিক্রি করতে হতো। দাম তেমন পাওয়া যেত না। পরের দিকে ট্রাকে করে তাঁরা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মাছ নেওয়া শুরু করেন। সেই সময় ট্রাকে এক-দুজন লোক রাখতে হতো। তাঁরা সারা রাস্তা পানিতে পা দোলাতেন (হিল দিত)। কিন্তু এখন শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি দেওয়া হয়। সে মেশিন সারা রাস্তা চলে। এতে মাছ পুকুরের মতো করে থেকে চলে যায়। দামও তাঁরা ভালো পান। ওই দিন এক ট্রাকে তিনি ১ হাজার ২০০ কেজি মাছ নিয়ে যান ঢাকার নিউমার্কেটে। সেদিন তিন লাখ টাকায় বিক্রি হয় ওই মাছ।
পারিলা গ্রাম থেকে প্রথম দফায় তাজা মাছ পাঠিয়েছেন যে কয়েকজন চাষি, তাঁদের মধ্যে সোহরাব হোসেন একজন। তিনি বলেন, মানুষ মরা মাছ নিয়ে নানা রকম কথা বলতেন। তাই তিনি বুদ্ধি করে তাজা মাছ পাঠাতে শুরু করলেন। এভাবে মাছ বিক্রি করায় এ এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।
দুর্গাপুর উপজেলার মৎস্যচাষি মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, তাঁর উপজেলা থেকে ৫০ ট্রাকের বেশি মাছ ঢাকায় যায়। তবে বর্তমানে মাছের দাম কিছুটা কমেছে। খাদ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, মাছের দাম তেমন বাড়েনি। এতে লাভ কম হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকায় মাছ নিতে বাড়তি ট্রাকভাড়া গুনতে হচ্ছে তিন-চার হাজার টাকা। তাঁরা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আর্থিক কোনো সহযোগিতা পান না। তবে নানা রকম পরামর্শ, সেমিনারের আয়োজন করেন। এতে তাঁরা উপকৃত হন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজশাহীতে মিশ্র প্রক্রিয়ায় মাছ চাষ বেশি হয়। পুকুরে প্রধান মাছ যদি রুই হয় তবে সিলভার কার্প, কাতলাসহ দেশি ছোট মাছও চাষ করা হয়। এর ফলে পুকুরে ভারসাম্য রক্ষা হয়। এই জেলা থেকে বড় মাছ পাঠানোর পাশাপাশি দেশি পাবদা, শিং, কই, মাগুর চাষ হয়। রীতিমতো সেগুলো রাজশাহীর বাইরে একটা বড় ধরনের বাজার তৈরি করে ফেলেছে। এ ছাড়া পাবদা মাছ নিয়মিতভাবে ভারতে রপ্তানি হচ্ছে।
মো. জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, এখানকার চাষিরা নিয়ম মেনে মাছ চাষ করেন। তাঁরা বছরে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে মাছ চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া তাঁরা নিয়মিত কৃষকের মাছ প্রদর্শনের মতো কর্মসূচি পালন করেন।