ক্যানসার আক্রান্ত শিশু তাহিয়াদের অপেক্ষা শেষ হবে কবে
চাঁদপুরের তিন বছরের তাহিয়ার ক্যানসার ধরা পড়েছে চার মাস আগে। তখন থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম রেজাউল করিমের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিল। তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় পাঁচ দিন আগে আবার ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখন আর এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা মিলছে না। হাসপাতালের বিছানায় অপেক্ষায় দিন কাটছে তার।
শিশুটির মা নাসরিন বেগম বলেন, ‘আগে রেজাউল স্যার নিয়মিত দেখতেন। তিনি নাকি অবসরে চলে গেছেন। তাই এখন বড় ডাক্তার কাউকে দেখাতে পারছি না। অন্য যাঁরা আছেন, তাঁরা যেভাবে বলছেন, সেভাবে চলছে। কবে একজন বিশেষজ্ঞ আসবেন জানি না।’
বিভাগটির প্রধান অধ্যাপক রেজাউল করিম এ বছরের ২৮ এপ্রিল অবসরে যান। এর পর থেকে বিভাগটির রোগীদের দুর্দশা শুরু হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ১৮ শয্যার বিভাগটির অধীনে নিয়মিত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ভর্তি থাকেন গড়ে ১৫ জন। বহির্বিভাগে সেবা নেন, অর্থাৎ কেমোথেরাপি দেওয়া হয় দিনে আরও ১৫-১৬ জনকে।
এখন হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসাসেবা চলছে রেজাউল করিমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে।
রেজাউল করিম যাওয়ার দেড় মাস পর দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে মন্ত্রণালয় থেকে চমেকে পদায়নের জন্য গতকাল বুধবার আদেশ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু যোগদান না করা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ, এর আগে গত ৪ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ তানভীর আহম্মদকে পদোন্নতি দিয়ে চট্টগ্রামে পদায়নের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর যোগদান করেননি।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আদেশ হয়েছে শুনেছি। কিন্তু এখনো আদেশ পাইনি।
তাঁরা যোগ দিলে রোগীদের দুর্দশা লাঘব হবে। কবে যোগদান করবেন তা বলা যাচ্ছে না।’
শূন্য চার পদ
চমেক শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ হওয়ার পর একজন অধ্যাপক, একজন সহযোগী অধ্যাপক ও দুজন সহকারী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু ওয়ার্ডটি চালিয়ে আসছিলেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। তখন থেকে আর কোনো বিশেষজ্ঞ দেওয়া হয়নি। মাঝখানে একজন সহকারী অধ্যাপক ছয় মাসের জন্য এসেছিলেন।
অথচ ঢাকা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও মাতুয়াইল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথ (আইসিএমএইচ) হাসপাতালে শিশু ক্যানসার বিভাগ নেই। সেখানে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে। চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলার একমাত্র নির্ভরতা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু ক্যানসার বিভাগ থেকেও বিশেষজ্ঞের জন্য হাহাকার করছে।
জানতে চাইলে এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি নিজেই অনেক চেষ্টা করেছি লোক আনার জন্য; কিন্তু পারিনি। চট্টগ্রামের মতো একটা বিভাগীয় হাসপাতালের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ খুব জরুরি। আমি ফোনে কতক্ষণ সেবা দিতে পারব?’
ক্যানসার চিকিৎসা যেমন দীর্ঘমেয়াদি তেমনি ব্যয়বহুল। চট্টগ্রামে সরকারিভাবে এই হাসপাতাল ছাড়া আর কোনো জায়গায় সেবা নেই। দু–একটি বেসরকারি হাসপাতাল সবে এই সেবা শুরু করলেও সেখানে সবার পক্ষে সেবা নেওয়ার সামর্থ্য নেই।
সরেজমিনে শিশু ক্যানসার বিভাগ
বুধবার দুপুরে শিশু ক্যানসার বা অনকোলজি বিভাগে দেখা যায় দুজন চিকিৎসক রোগী দেখছেন। ওই দিন এখানে ভর্তি রোগী ছিলেন ১৪ জন। বিভিন্ন শয্যায় ভর্তি হওয়া শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন সহকারী রেজিস্ট্রার শুভ্রা দাশ।
শুভ্রা জানান, তাঁরা রেজাউল করিমের পরামর্শ অনুযায়ী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কেমোথেরাপি ও অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়। সব সময় ফোনে যোগাযোগ করে সেবা দিয়ে থাকেন। কোনো রোগীর অবস্থা খারাপ হলে তাঁদের ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর বাইরে প্রতিদিন বহির্বিভাগে কেমোথেরাপি দিয়ে চলে যান অনেকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব অনুভব করছেন সব সময়।
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জেবীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ কেউ এখন কর্মরত নেই। স্যারের (রেজাউল করিম) সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনোরকমে চিকিৎসা কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
রাঙ্গুনিয়া থেকে এসে এক মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে চার বছরের আরিফুল ইসলাম। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত এই শিশুর মা লায়লা বেগম বলেন, কয়েক মাস আগে ছেলেটি আক্রান্ত হয়। তখন থেকেই এখানে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু এখন কোনো ‘বড় ডাক্তার’ না থাকায় সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
শুধু চিকিৎসা নয়, বিভাগটিতে ন্যূনতম সহকারী অধ্যাপক না থাকায় কলেজের পাঠদানও ব্যাহত হচ্ছে।
এ নিয়ে চমেক অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার ও চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন মন্ত্রণালয়ে পৃথক চিঠি দিয়েছেন।
জানতে চাইলে সাহেনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম যেহেতু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিভাগ, এখানে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লোক দেওয়া উচিত। আমরা লোক চেয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখেছি।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজনের বিষয়ে অর্ডার হয়ে যাওয়ার কথা। তারা যোগদান করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’