অন্যের চাবিতে নিজের ভাগ্যের তালা খুলেছে তাঁদের
সবে কৈশোরে পা রাখা আলাউদ্দীন বাবার বকুনি খেয়ে বাগেরহাটের চিতলমারি থেকে পা রাখেন শহর খুলনায়। অচেনা শহর আর অচেনা পরিবেশে সেই বয়সেই পথে নামতে হয় রুটি-রুজির তাগিদে। এরপর প্রয়োজনের তাগিদে সময়ে সময়ে বদলাতে হয়েছে পেশা। এখন তিনি পেশায় একজন তালা-চাবিওয়ালা। বিকল্প চাবি বানানোর এই কাজটা করছেন তা–ও ৪০ বছর হয়ে গেছে। বসেন খুলনার বড় বাজার এলাকার ক্লে রোডের ফুটপাতে। আলাউদ্দীনের উপার্জনের প্রথম ঠিকানাটাও ছিল খুলনা শহরের পুরোনো এই রাস্তার ফুটপাতেই।
রোববার দুপুরে ফুটপাতে বসে চাবি তৈরি করছিলেন আলাউদ্দীন। বিকল্প চাবি বানাতে মানুষ আসছেন। দেখেশুনে বানানোর খরচাপাতির কথা জানিয়ে দিচ্ছেন। বনিবনা হলে কাজে হাত দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শোনালেন এই পেশায় আসার পেছনের গল্প।
আলাপে আলাপে জানা গেল, আলাউদ্দীনের বয়স এখন ৫৭ বছর। কিশোর আলাউদ্দীন প্রথমে ক্লে রোডের এই ফুটপাতে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। এরপর বিক্রি শুরু করেন ছড়ার বই। পরে ফুটপাতেই কসমেটিকসের দোকান দেন। এসব করে কোনোমতে জীবন চালিয়ে নেওয়া গেলেও এগুলোর কোনোটাতেই তেমন স্বাচ্ছন্দ্য মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তালার চাবিতে তাঁর সংগ্রামের শিকল খুলেছে।
আলাউদ্দীন বলেন, ‘হালকা মোচের রেখা যখন দেখা দিয়েছে, তখন খুলনা আসি। এরপর নানা কাজ করেছি। বিয়ের পর কোনো একটা হাতের কাজ শেখার তাগিদ আসতে থাকে। আর তা থেকেই চাবি বানানোর কাজ শেখা। ৪০ বছর ধরে এই কাজ করছি। তালা চাবির মেকারি করি। নষ্ট তালা ঠিক করি। গ্যাস লাইট, টর্চ লাইট সারাই করি। ডাল-রুটির জোগাড় হয়েছে। ভালো আছি।’
খুলনায় আসার পেছনের কাহিনী থেকে জানা গেল, আলাউদ্দীনদের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারীর বেতিবুনিয়া গ্রাম। দশ ভাই–বোনের সংসারে অনটন ছিল। দেশ স্বাধীনের কিছু পরপর তাঁদের জমিজমা সব বন্ধকে আটকে পড়ে। কাজ করার জন্য বাড়ির চাপ থাকলেও সেসব ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন আলাউদ্দীন মুন্সি। রাগ করে বাবা একদিন তাঁকে খুব বকা দেন। অভিমানী কিশোর ঘর ছাড়েন। প্রথমে আসেন বাগেরহাটে। পকেটে থাকা কয়েকটা টাকা দিয়ে পাউরুটি কিনে বিক্রি শুরু করেন। উদাসী কিশোরের তাতে মন টানেনি। দুদিন পর রেললাইন ধরে চলে আসেন খুলনা শহরে। আলাউদ্দীন বলতে থাকেন, খুলনায় কয়েকটা দিন এক বোনের বাড়ি থাকার পর চাকরি জুটে যায়। পরে নানা পেশা বদলে এই পেশায় থিতু হয়েছেন তিনি।
আলাউদ্দীন মুন্সীরা এখন থাকেন নিজের বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটার সাচিবুনিয়ায়। প্রতিদিন সকাল নয়টায় বাড়ি থেকে রওনা দেন। ১০টার দিকে কাজ শুরু করে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। একেক দিন রোজগার একেক রকম। কোনো দিন ৫০০ টাকা, কোনো দিন আবার হাজার ছাড়িয়ে যায়। রোজগার ভালো থাকলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতির দাম প্রতিনিয়ত বাড়ায় সামনের সময় নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি।
শহরের ক্লে রোডের বুক চিরে এক দিকে চলে গেছে কেডি ঘোষ রোড, অন্য দিকে স্টেশন রোড। চার রাস্তার এই মোড়ের নাম বার্মাশীল মোড় নামেই বেশি পরিচিত। ঠিক এই মোড়েই বসেন তালা চাবির আরেক কারিগর মো. আবুল কালাম আজাদ। ৬৫ বছর বয়সী আজাদ এই রোডের সবচেয়ে পুরানো তালা–চাবির মিস্ত্রী। দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পর থেকেই এই রোডে তিনি চাবি তৈরির কাজ শুরু করেন। অবশ্য আজাদ এখন পেশাতে আর আগের মতো সময় দেন না। একটু বেলা করে কাজে আসেন। সন্ধ্যার পরপরই গুটিয়ে ফেলেন সরঞ্জাম। তাঁর পাশে কিছুক্ষণ বসে বোঝা গেল, খুব একটা দর কষাকষির ধার ধারেন না তিনি।
আজাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁদের আদি বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় আজাদের বাপ–দাদারা খুলনা আসেন। বাবার হাত ধরে তাঁর এই পেশাতে আসা। আজাদের দশ ভাইবোনের অন্য কেউ এই কাজে আসেননি।
আজাদ বলেন, ‘৫০ বছর ধরে তালা চাবির কাজ করছি। এই কাজ করেই বেশ ভালোমতো সংসার চালিয়েছি। আগে মানুষের বাড়িও যেতাম। এখন যাই না। এখন শহরে মানুষ বেড়েছে, কাজও বেড়েছে। তবে নতুনরা এই পেশায় খুব আগ্রহ দেখায় না। যদিও আমার দুজন সাগরেদ আছে।’ সারা দিনের রোজগার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজাদ বলেন, ‘সারা দিনে ফেলেঝেলে কম করে ৫০০-৬০০ টাকা থাকে। আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছে। আর আমার কোনো খরচা নেই।’ খরচ না থাকার ব্যাখ্যায় জানা গেল, আজাদের তিন মেয়ে। সবার বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। এক মেয়ে খাবার দিয়ে যান, তা দিয়ে চলে যায় তাঁর।
পুরোনো কারিগর আজাদের পেশার প্রতি এক ধরনের মমত্ব এসে গেছে। বয়স হলেও কাজটা ভালোবেসে করে যাচ্ছেন। আজাদ বলেন, ‘একার জীবন। তার ওপর বয়স হয়েছে, তবে বসে থাকতে পারি না। কাজটা করতে ভালো লাগে। আসল কথা হচ্ছে, কোনো একটা কিছু করতে করতে সেখানে একটা মায়া জন্মে যায়।’