মেহেদীর হাত ধরে ঘুচল চরের আঁধার

টুপিতে নারীদের করা নকশার কাজ দেখছেন মেহেদী হাসান। সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চরকান্দিনা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তিস্তা তীরের একটি গ্রাম। খেটে খাওয়া মানুষের বাসই বেশি। কেউ খেতমজুর, কেউ রিকশাচালক। চরের এই গ্রামে নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা বছরজুড়ে লেগেই থাকে। আছে ফসল না হওয়ার কষ্ট, অভাবের জ্বালা। এখন সে চিত্র অনেকখানি বদলেছে। গ্রামটির কয়েক শ নারী এখন স্বাবলম্বী। তাঁদের কেউ হাঁস-মুরগি পালেন। কেউ বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করেন। কেউ নকশিকাঁথা কিংবা টুপি বানানোর কাজ করেন। গ্রামটিতে এখন বাল্যবিবাহ হয় না বললেই চলে। টাকার অভাবে কেউ পরীক্ষা দিতে পারছে না; কারও বিয়ে আটকে আছে—এমন ঘটনা এখন নেই।

পীরগাছা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত ওই গ্রামে এত এত ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের নাম—‘স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’। এর উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ মেহেদী হাসান। বছর সাতেক আগে চরকান্দিনা গ্রামে সংগঠনের যাত্রা শুরু। আজ সেই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৪০০। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন মেহেদী।

শুরুর কথা

২০১৭ সালের মাঝামাঝি। মেহেদী তখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। গ্রামের দিনমজুর আবদুর রহিমের ছেলে পারভেজ হাসান টাকার অভাবে এসএসসির ফরম পূরণ করতে পারছিল না। মেহেদী নিজের পোষা একটি ছাগল বিক্রি করে পারভেজকে ফরম পূরণের টাকা দেন। এ কথা শুনে মেহেদীর বাবা শহিদুল ইসলাম ছেলেকে উৎসাহ দেন। মেহেদীর এমন পরহিতৈষী কাজকর্ম আরও আছে। গ্রামের অনেকে এগিয়ে এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আরও কিছু শিক্ষার্থী যোগ দিলেন মেহেদীর সঙ্গে।

তাঁরা নিজেরা চাঁদা দিয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠদান, উপকরণ সরবরাহ, দুস্থ রোগীকে অর্থদান, রক্তদান, বাল্যবিবাহ বন্ধসহ করছেন নানা কাজ। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তাঁরা করছেন, সেটি গ্রাম থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ কাজে নারীদের পেয়েছেন অগ্রগামী ভূমিকায়। সব মিলে আঁধার কেটে আলোকিত এক গ্রাম হয়ে উঠছে চরকান্দিনা।

ওই গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, মেহেদীর প্রচেষ্টায় গ্রামটি এখন অভাবমুক্ত। নারীরা বাড়িতে নকশার কাজ করছেন। ওই গ্রামের প্রায় আড়াই শ নারী-কিশোরী এখন স্বাবলম্বী। এ গ্রামের নারীদের দেখে আশপাশের অন্য গ্রামের নারীরাও আর অলস বসে নেই।

মেহেদীর খোঁজে

চরকান্দিনা গ্রামটিতে হাজার দেড়েক মানুষের বাস। ওই গ্রামেই মেহেদীর বাড়ি। কাঁচা-পাকা পথ ধরে তিস্তা নদীবেষ্টিত গ্রামটির কাছে যেতেই চোখে পড়ে নানামুখী কর্মকাণ্ড। প্রতিটি বাড়ির সামনে নানা পদের সবজি ও মসলার খেত। উঠানে হাঁস-মুরগি আর গরু-ছাগলের বিচরণ। নারীদের অনেকে টুপি, নকশিকাঁথা ও রঙিন হাতপাখা বুননে ব্যস্ত। প্রতিটি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। কোথাও কুঁড়েঘর চোখে পড়ল না।

১৮ ডিসেম্বর মেহেদীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি বাড়ির উঠানে শিশুদের পড়াচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বসতে দেন, শোনান তাঁর ‘গ্রাম গড়ার’ গল্প। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় মেহেদী। ডাকনাম রাব্বি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারে পড়ছেন।

বাবা শহিদুল ইসলাম ও মা সাবিনা আক্তার দুজনই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজেদের ১৫ একর জমি আছে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা ভাবতেন মেহেদী। টিফিনের টাকা জমিয়ে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতেন। গ্রামের কেউ অনাহারে আছে শুনলে নিজের খাবার নিয়ে ছুটে যেতেন।

সংগঠনের কাজ

মেহেদী জানান, শুরুতে গ্রামের ১০০ জন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করেন। নারীরা সপ্তাহে ১০০ টাকা করে সংগঠনে জমা দেন। প্রথম সপ্তাহে ১০০ জনের ১০ হাজার টাকা জমা হয়। ১০০ জনের মধ্যে লটারি করে একজনকে দুটি ছাগল, হাঁস-মুরগি কিনে দেওয়া হয়। একইভাবে পরের সপ্তাহে বাকিদের লটারি করে একজনকে ছাগল, হাঁস-মুরগি কিনে দেওয়া হয়। এভাবে ১০০ সপ্তাহে ১০০ জন গৃহবধূকে দুটি করে ছাগল ও হাঁস-মুরগি কিনে দেওয়া হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। সংগঠনের প্রাথমিক এই সাফল্য আত্মবিশ্বাসী করে তোলে মেহেদীকে। তিনি উপজেলা যুব উন্নয়ন ও পল্লী উন্নয়ন অফিসে যোগাযোগ করে সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র নারীদের হাতপাখা, নকশিকাঁথা ও কাপড়ে নকশার তৈরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। বদলে যেতে শুরু করে গ্রামের চিত্র। নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। সংগঠনের কার্যক্রম অন্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করে। তাঁরাও ভিড়তে থাকেন সংগঠনে। এখন এই সংগঠনের সদস্য ৪০০ জন। সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা করে দিয়ে আগের নিয়মে লটারি করে কেউ গরু কিনছেন, কেউ করছেন ব্যবসা। পুরো প্রক্রিয়ায় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক মাইদুল ইসলাম।

মাইদুল বলেন, ‘ত্রাণ দিয়ে কাউকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তাকে যাতে স্বনির্ভর করে তোলা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। গ্রামের উন্নয়নে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মেহেদীর সঙ্গে একজোট হয়েছেন।’

মেহেদী ও ওই সংগঠনের কাজকর্ম সম্পর্কে জানেন পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদীর কাজ প্রশংসার দাবিদার। তিনি সত্যিকার অর্থে মানুষের উপকার করছেন।

সংগঠনের খরচ চলে কীভাবে জানতে চাইলে সংগঠনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের তহবিলে ৬ লাখ টাকা জমা আছে। একটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ চলছে। নারীদের তৈরি টুপি, নকশিকাঁথা, হাতপাখা সংগঠনের মাধ্যমে বিক্রি করে যে আয় হয়, সেখান থেকে প্রতি পিসে ১০ টাকা করে সংগঠনের তহবিলে জমা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ১০০ জন সদস্য প্রতি মাসে ১০ টাকা করে চাঁদা দেন। সংগঠনের মাধ্যমে ঢেঁকিছাঁটা চাল বিক্রি করে যে লাভ হয়, তারও একটি অংশ তহবিলে জমা করা হয়। এভাবেই সংগঠনের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। বছরে দুবার সংগঠনের সদস্যেদের ডেকে আয়-ব্যয়ের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

স্বাবলম্বীদের কথা

চরকান্দিনা গ্রামের গৃহবধূ শিরিন আক্তারের (৩২) পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫। উপার্জনকারী ছিলেন শুধু তাঁর স্বামী আবদুর রহিম। দিনমজুরি করে যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার কোনোরকমে টেনেটুনে চলত। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। স্বামীর পাশাপাশি শিরিন নিজেও নকশার কাজ করে উপার্জন করছেন। তিনি বলেন, ‘সেই কষ্ট আর নাই। ছাওয়াগুলা স্কুল যাওছে। গরু-ছাগল আছে। ভাত-কাপড়ে শান্তিতে আছি। মেহেদী ভাইয়ের জন্যে এত কিছু পাইছি।’

গৃহবধূ ফুলতির (৩৫) বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে। অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন একসময়। নকশার কাজ করে এখন সচ্ছলতা এসেছে সংসারে। বাড়িতে টিনের ঘর উঠেছে, নলকূপ বসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারও হয়েছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ১২ শতক জমি বন্ধক নিয়েছেন। স্বামীও পাওটানা বাজারে সবজির ব্যবসা করছেন।

জানতে চাইলে ছাওলা ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা ইউপি সদস্য লাভলী বেগম বলেন, মেহেদীর গড়া সংগঠনের কাজকর্ম ভালো। সংগঠনের সদস্যদের কারণে কান্দিনা গ্রামে যৌতুক, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে না। সব শিশু স্কুল যাচ্ছে।

নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড

ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে ২০২০ সালে চালু করা হয় একটি শিক্ষাকেন্দ্র। গ্রামের শিশুরা এই কেন্দ্রে লেখাপড়া শিখে পরে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। নিরক্ষর নারী-পুরুষদেরও এ কেন্দ্রে লেখাপড়া শেখানো হয়। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পালা করে শিশুদের পাঠদান করান। গ্রামের শিশুদের শতভাগ স্কুলমুখী করতে সংগঠনের উদ্যোগে ছয়জন নারী ও একজন পুরুষকে নিয়ে একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ওই কমিটির সভাপতি নাহিদ মিয়া বলেন, এই কমিটির সদস্যরা শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি ছাড়াও ঘরে ঘরে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নারীদের ধারণা দেন। শিশুদের সময়মতো টিকা দেওয়া হয়েছে কি না, তার খোঁজ নেন।

সংগঠনটি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে নিবন্ধনভুক্ত। তাদের উদ্যোগে এ পর্যন্ত ৩ হাজার মানুষকে রক্ত দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে ৩৩ জনকে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গঠন করা হয়েছে কমিটি। সচেতনতা বাড়াতে আয়োজন করা হয় পথনাটকের। গৃহবধূদের নিয়ে পাড়ায় উঠান বৈঠকও বসে।

পীরগাছা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের তরুণদের কর্মকাণ্ড ভালো। তাঁরা অসহায়দের কল্যাণে কাজ করছেন।

ভবিষ্যৎ যাত্রা

৫ ডিসেম্বর দেশসেরা স্বেচ্ছাসেবীর পুরস্কার পেয়েছেন মেহেদী হাসান। আন্তর্জাতিক ভলান্টিয়ার দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে মেহেদীর হাতে ওই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক ও দাতব্য সংস্থা ভলান্টিয়ার সার্ভিস ওভারসিস (ভিএসও-বাংলাদেশ)।

মেহেদী হাসান বলেন, ‘সংগঠনটি আমার প্রাণ। এটি আরও বড় করার ইচ্ছা আছে। যত দিন বেঁচে থাকব, মানুষের সেবা করে যাব। আমাদের লক্ষ্য চরাঞ্চলের অন্ধকার, কুসংস্কার দূর করে বেকার নারী ও যুবকদের কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করা। একই সঙ্গে তরুণদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্তুত করা।’